আসমানি আপদ

.
.

নাদিম ভয়ে ভয়ে একটা রিকশা খোঁজে। অফিসে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। সাতসকালেই ছুটতে হয়। এ সময় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের একটা হুড়োহুড়ি চলে। কাজেই রিকশা ধরা সহজ কথা নয়।
নাদিমের ভয়টা অন্যখানে। প্রায়ই এমন হয়, রিকশা না পেয়ে যখন ও গাল চুলকাচ্ছে, এ সময় স্যাঁৎ করে সাদু মিয়া হাজির। তখন তার রিকশায় না উঠে উপায় নেই। সাদু মিয়া শক্তপোক্ত গড়নের এক বয়স্ক রিকশাচালক। প্যাডেলের চেয়ে তার কথার জোরটা বেশি। সারাক্ষণ বকবক করে কান ঝালাপালা করে। আর জ্ঞানের থলেতে যা আছে, উদার চিত্তে উগরে দেয়।
নাদিমের কপালে আজও খ্যাংরাকাঠি নাচে। যে রিকশাই ধরতে যায়, সেটা হাতছাড়া হয়ে যায়। শেষমেশ যাওবা একটা রিকশায় উঠে বসে, ছোট এক শিশুর মা এসে কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘রিকশাটা একটু দেবেন, ভাইয়া। আমার ছেলের স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
নাদান সেজে নেমে পড়ে নাদিম। হাত নাড়তে নাড়তে চলে যায় মা আর ছেলে। নাদিম একটা ইলাস্টিক হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, রিকশার টুংটাং বেল থামিয়ে দিল। সাদু মিয়া যথারীতি হাজির। দরাজ দিলে বলে, ‘আহেন স্যার, আফনেরে নামাইয়া দিয়া আসি।’
নাদিম উঠে পড়ে। সাদু মিয়া প্যাডেল মারতে মারতে তার প্রিয় বিষয় দেশের হালচাল টেনে আনে। নাদিম তাকে থামিয়ে দেওয়ার ছল করে, ‘এই সাতসকালেই বিড়ি ফুঁকেছ, চাচা? এটা একটা কাজ হলো!’
সাদু মিয়া অমনি জবাব দেয়, ‘এই জীবনে ভুল তো দুইখানই করছি, স্যার! একটা হইল বিড়ি ধইরা, আরেকটা বিয়া কইরা! কোনোটাই ছাড়তে পারলাম না।’
নাদিম কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় ওপর থেকে জলকণা পড়ে মাথায়। গোসল সেরে ফিটফাট হয়ে যাওয়ার সময় যদি এমন কিছু ঘটে, কেমন লাগে?
বৃষ্টির পানি হলেও না হয় কথা ছিল। কেউ হয়তো বারান্দার ফুল গাছে পানি ঢালছিল, সেখান থেকে খানিকটা ছিটকে পড়েছে। এমনও হতে পারে, কেউ হয়তো গ্লাসের আধ খাওয়া পানি ছুড়েছে। এটা কুলকুচার পানি নয় তো? কিংবা বাবু গোছের কারও হিসু...? গা ঘিন ঘিন করে নাদিমের।
সাদু মিয়ার গায়েও পড়েছে কয়েক ফোঁটা। সে শুঁকে বলে, ‘খারাপ পানি না, স্যার। একটু ধৈর্য ধরেন।’
ধৈর্য নিয়ে নাদিমকে মোটামুটি একটা ছবক দিয়ে ফেলে সাদু মিয়া। এতে কী ফল পাওয়া যায়, এ নিয়ে একটা গল্পও শোনায়।
নাদিম মনে মনে মহা বিরক্ত। ঢাকার একেক এলাকায় একেক সমস্যা। এর আগে যেখানে ছিল, সেখানে অলিগলিতে ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। খানাখন্দে ভরপুর। একবার তো সেঁধিয়ে গিয়েছিল কোমর অবধি। সজ্জন পথচারী কয়েকজন টেনে তুলেছিল। এ জন্যই তো এলাকা বদল। এখানে পথঘাট অতটা খারাপ নয়, খালি ওপর থেকে পড়ে। আসমানি আপদ আরকি।
এই তো, কিছুদিন আগে বিকেলে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে, নির্মাণাধীন এক বাড়ি থেকে মাথার ওপর ঝুরঝুর করে পড়ল এক গাদা বালু। উফ্, কী যন্ত্রণা!
দুদিন আগে এক বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে, এক গাদা টমেটো এসে পড়ল মাথায়। কুকুর-বিড়াল বৃষ্টির কথা শোনা যায়। কিন্তু টমেটো বৃষ্টির কথা জন্মেও না। ওপরের দিকে তাকাতেই মুখে ঘোমটা টেনে চলে গেল এক বুয়া। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে এ কথা বলতেই সে ঝাঁজিয়ে ওঠে, ‘টমেটো ফালাইত না কী করত! এমুন কেমিকেল দিছে, তিন মাস অইয়া গেছে, তবু পচে না! এইটা খাওয়া যায়! তবে ভদ্রলোকের গায়ে ফেলাটা তার ঠিক হয় নাই। মাফ কইরা দিয়েন, স্যার!’
এখানে প্রথম দিনই অবশ্য প্রতিবেশী খালাম্মা নাদিমকে সতর্ক করেছিলেন, ‘রাস্তাঘাটে চলতে একটু সাবধানে থাইকো, বাবা। এই এলাকার লোকজনের স্বভাব ভালো না। খালি ওপর থিকা ময়লা ফেলে!’
কথাটা এক্কেবারে ঠিক। হাড়ে হাড়ে সত্যি।
সামনেই একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ। রাস্তার ওপর ছড়ানো ডালে বসে কা কা করছে দুটি কাক। মতলব মোটেও ভালো নয়। এই এলাকারই বায়স কিনা! রিকশার হুড তুলে দেয় ও।
ঠিক এ সময় শশীর রিকশাটা পাশ কেটে যায়। নাদিম যখন খেয়াল করেছে, ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়েছে। শশীও নাদিমের প্রতিবেশী। সম্পর্কে সবে বাষ্প ছুটেছে, এ সময় হুড তুলে দেওয়া মানে কড়িকাঠে করাত।
খানিক পর ঠিকই ফোন আসে, ‘নাদিম ভাই, আপনি আমাকে দেখে রিকশার হুড তুলে দিলেন কেন?’
‘কই দিলাম? তুমি কোথায়?’
‘ন্যাকামো করবেন না তো। আপনার পাশ দিয়ে যে আমি গেলাম, ঠিকই দেখেছেন। আপনার চোরা চাউনি কি আমি চিনি না?’
‘মাইন্ড কোরো না, প্লিজ! ফিরে এসে সব বলব।’
‘আচ্ছা, বাথরুমে আটকা পড়েন আরেকবার। তখন দেখব, কে পানি দেয়।’
লাইন কেটে দেয় শশী। একটা ঢোঁক গেলে নাদিম। এখানে আসার পরপরই সেটা ঘটেছিল। গোসল করার সময় গায়ে সাবান মেখেছে, এমন সময় শাওয়ারে পানি নেই। কী বিপদ! নাদিম তো একলা, কাকে ডাকবে? এখানে নতুন যে কজনের মোবাইল নম্বর নিয়েছে, প্রথমে শশীর নম্বরই মাথায় এল। ফোনে ওকে বলতেই ছোট ভাইটাকে দিয়ে এক বালতি পানি পাঠিয়ে দিল। সে ছোট্ট এক বালতি। মোটে কয়েক মগ পানি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই টেটনা বাবু বলে ওঠে, ‘আমি ছোট মানুষ না, এত বড় বালতি আনতে পারব?’
নাদিম ওই দিয়ে কোনোমতে কাজ সেরেছে। এখন শশীর কাছে সে ঘটনা ব্যালিস্টিক মিসাইল।
দিনটাই মাটি হয়ে যায় নাদিমের। কখন বাসায় ফিরে গোসল করবে, এই ব্যাকুলতা কাজ সব ভন্ডুল করে দেয়। বারবার ভুল করে বসে। বসের একচোট বকুনি খেয়ে বিকেলে মুখ ব্যাদান করে ফেরে নাদিম। রিকশা থেকে যেই নেমেছে, অমনি তরল কিছু একটা এসে পড়ে কাঁধে। ঘাড় ফেরাতেই চমকে ওঠে নাদিম। লাল হয়ে গেছে জায়গাটা। রক্ত নাকি?
পরমুহূর্তে ভুল ভাঙে প্রতিবেশী খালাম্মার আর্তনাদে, ‘আহ্হা, পানের পিকটা তোমার ওপরই পড়ল গিয়া! কিছু মনে কইরো না, বাবা! ভুল তো ভুলই। চরি (সরি)!’