ট্রেনের নাম শাটল

শাটল ট্রেনের গন্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল ছবি
শাটল ট্রেনের গন্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল ছবি

তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে/ কীভাবে যে ক্ষয়ে গেছি অন্তরে বাহিরে/ কীভাবে যে হয়ে গেছি নিঃস্ব রিক্ত উদ্দামহীন’। দরাজ গলায় আবৃত্তি করছিলেন অর্থনীতির শিক্ষার্থী সাজিদ। মাঝে তাঁর বন্ধুরা ধুয়ো দিচ্ছিলেন ‘আহা!’, ‘সাধু!’। কিন্তু হঠাৎ আরেক বন্ধু অনীক সব বগি ঘুরে এসে জানাল, ‘দোস্ত, শান্তা তো আজ এই বগিতে ওঠেনি।’ মুহূর্তেই সব উদ্যম হারিয়ে ফেলল সাজিদ ‘আমার এত বড় সাধনা এমন মাঠে মারা গেল! কাল রাত জেগে মুখস্থ করলাম কবিতাটা। দূর! বন্ধুরা আবার ধুয়ো তুলল, ‘হায় হায়’। আর অন্য শ্রোতারা বদ্ধ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের যাত্রীরা এমনই। কারণে-অকারণে হেসে উঠতে পারে আমূল। হাসি-গান-আড্ডায় মাতোয়ারা সারাক্ষণ। আর এই অসাধারণ প্রাণবান তারুণ্যের বাহন বলেই হয়তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলও হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। উদরভর্তি একঝাঁক উচ্ছল যাত্রী নিয়ে শাটল ট্রেন রাজকীয় চালে হেলেদুলে ভেঁপু বাজিয়ে চলছে। ট্রেনের ছাদ থেকে শুরু করে দরজা পর্যন্ত কোথাও তিলধারণের ঠাঁই নেই। গরমে ঘেমে-নেয়ে অস্থির সবাই। তবু কী আনন্দ ছড়ানো মুখে! গলায় বাজছে গান! আশপাশের লোকজন অবাক হয়ে এই মজার দৃশ্য দেখছে আর আপনমনে হাসছে। এই শাটল নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। চারুকলার শিক্ষার্থী নদী যেমন বললেন, ‘আমাদের যেকোনো উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্র শাটল ট্রেন। পয়লা বৈশাখ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নিজেদের আগে আমরা আমাদের প্রাণের শাটলকে সাজাই। শাটল দেখে সবাই বুঝতে পারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হতে চলেছে। শাটল নিয়ে কবিতা, উপন্যাস এমনকি টেলিফিল্ম পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। আর গান তো প্রায়ই হচ্ছে।’

শাটল ট্রেনের সজ্জা দেখেই নদীর কথার সত্যতা মেলে। প্রতিটি বগিতে শোভা পাচ্ছে বিচিত্র আলপনা। বগির গায়ে বড় করে লেখা আছে নাম—এপিটাফ, সাম্পান, একাকার, মহাপাপী; রয়েছে কিছু মজার নাম-ফাটাফাটি, ৬৯, সিএফসি ইত্যাদি। শাটলে উঠে প্রথমেই চোখে পড়ে সিট দখলের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেককে। কিন্তু বগির দুপ্রান্তেই যে বসেছে জলসা। তবলা, তানপুরা নেই তো কী! ট্রেনের গায়ে শক্ত হাতের চাপড়ে বেজে চলছে নিখুঁত বাজনা। শাটল সিঙ্গাররা একের পর এক বিখ্যাত গানের প্যারোডি গেয়ে যাচ্ছেন। গাইছেন নিজেদের লেখা, সুর করা গানও। এই আনন্দযজ্ঞের মধ্যে পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই চুনমুখোরা হাসিমুখ হয়ে যান। গলা মেলান শাটল সিঙ্গারদের সঙ্গে। শাটলের মেঝেতে পা ঠুকে তোলেন তাল।

যাঁদের গানে উৎসাহ নেই, তাঁরা মেতেছেন আড্ডায়, কেউ কেউ করছেন নোট নিয়ে কাড়াকাড়ি, নানা ছুঁতোয় জুটিরা ব্যস্ত খুনসুটিতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর বন্ধুতা কিংবা প্রেমের শুরু শাটলেই। হিসাববিজ্ঞানের সমীর আর ইতিহাসের শান্তার ভালোবাসার গল্পটি যেমন। আলাদা অনুষদের হওয়ায় কেউ কাউকে চিনতেন না। শাটলেই পরিচয়। শান্তা শোনালেন সে গল্প, ‘সিট পাচ্ছিলাম না সেদিন। বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ তাঁর দয়া হলো শুধু আমার জন্য। নিজে উঠে গিয়ে বসতে দিলেন। ব্যস আমিও পটে গেলাম। এখন বুঝি ওটা ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। হি হি হি...’। এই হাসি-প্রেম-বন্ধুতার বিপরীতটিও ঘটে শাটলে।

গানের ট্রেন শাটলে সেদিন বেজে ওঠে কবিগুরুর গান ‘সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে / চাঁদের আলোর দেশে গেছে...’। কিছু দুঃখ আছে, কান্না আছে জড়িয়ে। কিন্তু তবু চবির শাটল মানেই আশ্চর্য প্রাণবন্ত যাত্রা—যে যাত্রা চুকেবুকে গেলে হঠাৎই নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হয়, ভীষণ একা মনে হয়।