ফেসবুকের এক দশক

১০ বছর পূর্ণ করল ফেসবুক। এক দশক পেরিয়েও বিশ্বের বৃহত্তম এই সামাজিক যোগাযোগের সাইটটি এখনো পূর্ণতার পথ খুঁজে ফিরছে। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ফেসবুকের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, ফেসবুক।
২০০৪ সালে হার্ভার্ডের ডরমেটরিতে মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর বন্ধুদের হাতে তৈরি ফেসবুক এখন এক বিস্ময়। প্রযুক্তি-বিশ্বে এখন ১২০ কোটি মানুষের বিশাল এক যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ফেসবুক।
২০০৪ সালে হার্ভার্ডের ডরমেটরিতে ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র অ্যাডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিজ ও ক্রিস হিউজ। ফেসবুকের সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ, আইভি লিগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। আরও পরে এটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুল এবং ১৩ বছর বা ততোধিক বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
গ্লোবাল ইকুইটিস রিসার্চের বিশ্লেষক ট্রিপ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘ফেসবুক আমাদের বিশ্বকে ছোট করে এনেছে এবং আরও বেশি যোগাযোগ-বান্ধব করে তুলেছে।’
সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে ফেসবুক। মিসর, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ফেসবুক ‘আরব বসন্ত’খ্যাত গণজোয়ার তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা সরকার উত্খাতের মতো বিপ্লব তৈরি করতে যোগাযোগে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
তবে মার্কিন গবেষকেরা বলছেন, ফেসবুক সামাজিক বিপ্লব তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে কিন্তু এই বিপ্লব নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়।
ফেসবুকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ফেসবুক বিশ্বের ১০০ কোটির বেশি মানুষকে সামাজিক যোগাযোগের বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে ফেলেছে।
ফেসবুকের সহ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ জানিয়েছেন, তাঁর মিশন বা লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বকে আরও বেশি উন্মুক্ত করা এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের আরও বেশি যোগাযোগ তৈরি করা। অনেকেই মনে করেন গত এক দশকে জাকারবার্গ তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।
সোশ্যাল ইন্টারনেট ফান্ডের সহ প্রতিষ্ঠাতা লু কার্নার জানিয়েছেন, ‘মানুষ এখন ইন্টারনেটে যতটুকু সময় কাটায় তার শতকরা ২০ ভাগ সময় শুধু ফেসবুকেই কাটায়।’
১০ বছর ধরে ফেসবুকের ক্রমাগত উঠে আসা ও বিশাল সাফল্যের পরও ফেসবুকের ভবিষ্যত্ নিয়ে অনিশ্চয়তাও রয়েছে বলেও সতর্ক করছেন গবেষকেরা। তাঁরা দাবি করছেন, নিজের সাফল্যের বলি হয়ে যেতে পারে সাইটটি। ব্যবহারকারী ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে না পারলে দ্রুতই হারিয়ে যাবে এই তুমুল জনপ্রিয়তা।
ফেসবুকের শুরুর দিকে শুধু তরুণ ও শিক্ষার্থীদের কাছে এটা ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। কিন্তু এখন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ও তাঁদের বয়সের গণ্ডি অতিক্রম করেছে এটি। ফেসবুকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ফেসবুকে একশো ২৩ কোটি সক্রিয় অ্যাকাউন্ট রয়েছে যার মধ্যে অসংখ্য মানুষ মোবাইল থেকে ফেসবুক ব্যবহার করছেন।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বয়স বিবেচনায় এনে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। কেন উঠছে এ প্রশ্ন? আইস্ট্র্যাটেজিল্যাবসের এক গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে তরুণদের মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। শতকরা ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী তরুণরা ফেসবুকে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। তাঁদের কথা হচ্ছে ‘ফেসবুক নানি-দাদির আমলে পড়ে রয়েছে’। তবে আশার কথা হচ্ছে, বয়স্কদের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারের হার বাড়ছে।
তবে সোশ্যাল বেকার্সের তথ্য অনুযায়ী, এখনো অনেক তরুণের কাছে তীব্র আকর্ষণের নাম ফেসবুক। বিশেষ পরিণত মানুষ অর্থাত্ ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীরাই এখন বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন।
গত ১০ বছরে একটি কোম্পানি হিসেবেও বড় হয়ে উঠছে ফেসবুক। ২০১২ সালে পাবলিক লিমিটেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ফেসবুক। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমার্কেটারের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে আয়ের দিক থেকে বর্তমানে গুগলের পরের অবস্থানেই রয়েছে ফেসবুক। মোবাইল বিজ্ঞাপন থেকেও ফেসবুকের আয় বাড়ছে।
ফেসবুক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনছে নিয়মিত। কিনছে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা ফেসবুকের সঙ্গে যুক্তও করছে। ফেসবুকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট ৪৩টি প্রযুক্তি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কিনেছে ফেসবুক যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোয়ালা, ইনস্টাগ্রাম, লাইটবক্স ‘লিটল আই ল্যাবস’, ব্রাঞ্চ প্রভৃতি।
ফেসবুকের জন্য অবশ্য কিছু আশার কথাও গবেষকেরা বলছেন। তাঁদের মতে, ফেসবুকের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের পথে খুব বেশি অসাধারণ হওয়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ, চিরদিন কোনে কিছুই অসাধারণ হয়ে থাকে না। কিছু কিছু বিষয় অসাধারণ হয়ে ওঠে মাত্র। আর ফেসবুক গত ১০ বছরে সেই অসাধারণের তালিকায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠান।
একনজরে ফেসবুকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা
২০০৪, ফেব্রুয়ারি: ফেসবুকের যাত্রা শুরু।
২০০৪, মার্চ: ফেসবুকের বিস্তৃতি শুরু।
২০০৪, জুন: ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেসবুকের সদর দপ্তর স্থাপিত।
২০০৪, সেপ্টেম্বর: ফেসবুকের ‘ওয়াল’ ফিচার উন্মুক্ত। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের বিরুদ্ধে ক্যামেরুন ও টেইলর উইঙ্কলভস যমজ ভাইয়ের মামলা।
২০০৫, সেপ্টেম্বর: ফেসবুকে জনপ্রিয়তার শুরু।
২০০৬, মে: ফেসবুক নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি।
২০০৬, সেপ্টেম্বর: ১৩ বছরের ওপর যে কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবেন এ সিদ্ধান্ত গৃহীত।
২০০৭, মে: গেম প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুকের আত্মপ্রকাশ।
২০০৭, অক্টোবর: মাইক্রোসফটের কাছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার বিক্রি।
২০০৮, মার্চ: শেরিল স্যান্ডবার্গ চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে ফেসবুকে যোগ দেন।
২০০৮, এপ্রিল: ফেসবুক চ্যাট সার্ভিসের যাত্রা শুরু।
২০০৯, ফেব্রুয়ারি: ফেসবুকে লাইক যুক্ত।
২০০৯, জুন: অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট হিসেবে মাইস্পেসকে অতিক্রম করে শীর্ষে ফেসবুক।
২০১০, আগস্ট: ফেসবুকে লোকেশন ফিচার।
২০১০, অক্টোবর: ফেসবুক তৈরির কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মুক্তি।
২০১১, জুন: ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী গুগল প্লাসের জন্ম। উইঙ্কলভস যমজের মামলা প্রত্যাহার।
২০১১, সেপ্টেম্বর: ফেসবুকে টাইম লাইন উন্মুক্ত।
২০১২, জানুয়ারি: টাইম লাইনকে বাধ্যতামূলক করে ফেসবুক।
২০১২, ফেব্রুয়ারি: আইপিওর জন্য আবেদন করে ফেসবুক।
২০১২, এপ্রিল: ইনস্টাগ্রাম কেনে ফেসবুক
২০১৩ ফেব্রুয়ারি: গ্রাফ সার্চ চালুর ঘোষণা দেয় ফেসবুক।
২০১৪: পেপার অ্যাপ উন্মুক্ত
আরও পড়ুন: