বাংলা ডোমেইনে আগ্রহ বাড়ছে

ডট বাংলা, ডটবিডি।
ডট বাংলা, ডটবিডি।

বিশ্বজুড়ে ডোমেইন নিবন্ধনের হার বাড়ছে। বাংলা ভাষাতেও ডোমেইন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়তে দেখা গেছে। বর্তমানে ডটবাংলা ও ডটবিডি মিলিয়ে নিবন্ধিত ডোমেইনের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৩৭১। এর মধ্যে ডটবিডি নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ৪৬ হাজার ৮০০ ও ডটবাংলা নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ৫৭১। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কোনো একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এই ডোমেইন। যেমন ডটইউকে ডোমেইন নামের কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকলেই বোঝা যাবে, সেটি যুক্তরাজ্যের ওয়েবসাইট। তেমনই ইউনিকোড দিয়ে স্বীকৃত বাংলাদেশি ডোমেইন হলো ডটবাংলা। বাংলাদেশের জন্য আইসিএএনএনের স্বীকৃত দুটি ডোমেইনের একটি হলো ডটবাংলা ও আরেকটি হলো ডটবিডি (.বিডি)।

২০১৬ সালে ডটবাংলা (.বাংলা) ডোমেইন চূড়ান্ত বরাদ্দ পায় বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ডটবাংলা আইডিএনের যাত্রা শুরু হয়।

ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম (আইডিএন) একটি ইন্টারনেট ডোমেইন নেম সিস্টেম, যা ওয়েব ঠিকানা লিখতে প্রচলিত ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা সমর্থন করে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত সরকারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ এবং সিয়েরা লিওনও ‘.বাংলা’র জন্য আবেদন করেছিল।

ডটবাংলা ডোমেইন চালুর ফলে ইন্টারনেটে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ মাতৃভাষায় ইন্টারনেটে প্রবেশ ও ব্যবহার করার সুযোগ হয়। এর ফলে ইন্টারনেটে বাংলা ভাষা ব্যবহার বৃদ্ধিসহ বাংলা কনটেন্ট তৈরি উৎসাহ বেড়েছে। এ ছাড়া ডটবাংলা ডোমেইন সর্বস্তরের বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

ডটবাংলা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি দ্বিতীয় ইন্টারনেট কান্ট্রি কোড টপ লেভেল ডোমেইন (সিসিটিএলডি)। এই ডোমেইন বাংলা ভাষায় ওয়েব ঠিকানার জন্য বোঝানো হয়। বিটিসিএল ডটবাংলা ডোমেইনের টেকনিক্যাল কনটাক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, আগে শুধু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ডটবাংলা বা ডটবিডি ডোমেইনে আগ্রহ বেশি ছিল। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডটবাংলা ও ডটবিডি ডোমেইনের ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে।

বিটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, ডটবাংলা ও ডটবিডি ব্যবহারে অনেকের আগ্রহ বাড়ছে। নতুন করে সবাই এ ধরনের ডোমেইনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নতুন নতুন উদ্যোক্তা, ব্যক্তিপর্যায় ছাড়াও ব্যবসায়িক ও নানা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ডোমেইনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর আগে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছিল। তবে অনেকেই ডোমেইন রিনিউ না করায় বেশ কিছু ডোমেইন নিববন্ধন বাতিল হয়ে গেছে।

ডটবাংলা ডোমেইন অনেকে কিনলেও পরে নিবন্ধন রাখেননি। তবে গত বছরের তুলনায় ডটবিডি নিবন্ধন বাড়তে দেখা গেছে। গত বছরের শেষ দিকে ডটবিডির নিবন্ধন ছিল ৪৬ হাজারের বেশি।

ডটবাংলা ও ডটবিডির আগ্রহ নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন ডটবিডি আর ডটবাংলা শুরু করি, তখন লোকজন বলে, এগুলো কী হবে? ইংরেজি ছাড়া দুনিয়াতে কিছু হবে না। বাংলার জন্য ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করার ইচ্ছা নিয়ে কাজ করেছি। বাংলা ডোমেইনের দাম কমিয়ে ৭০০ টাকায় নামানো হয়েছে। তার ফল আমরা পেতে শুরু করেছি।’

ডোমেইন নাম সহজ করার উদ্যোগ
গত বছর থেকে বাংলা ভাষায় ডোমেইনের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক ডোমেইন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইসিএএনএন)। আইসিএএনএনের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, ভারত থেকে ২২টি ভাষায় ডোমেইন নাম দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে তারা। বিষয়টি অনুমোদিত হয়ে গেলে ইংরেজি নামের ডোমেইন আর না কিনলেও চলবে। আইসিএএনএন আরও জানায়, নয়টি ভারতীয় স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ চলছে। তার মধ্যে আছে বাংলা, দেবনাগরি, গুজরাটি, গুরুমুখী, কান্নাডা, মালায়ালম, ওডিশি, তামিল ও তেলেগু। তবে বাংলা ভাষা ছাড়া বাকি আটটি ভাষার স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অক্ষর ব্যবহার নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ওই স্ক্রিপ্ট অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আইসিএএনএন ভারতের প্রধান বলেন, বর্তমান বিশ্বে ৫২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আছে। আইসিএএনএন বর্তমানে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করছে। অনলাইনের বাইরে থাকা বাকি ৪৮ শতাংশ মানুষের অনেকেই ইংরেজি বলতে পারে না বা টাইপ করতে পারে না। স্থানীয় ভাষায় ডোমেইন পাওয়া গেলে অনেকের জন্য সুবিধা হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ভাষাপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মামুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের কাজ করছেন। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তিমাধ্যমে (ওয়েব, মোবাইল, কমপিউটার) ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন সফটওয়্যার/টুল/রিসোর্স উন্নয়ন করা, যাতে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে ব্যবহার করতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার জন্য ১৬টি সফটওয়্যার/টুল/রিসোর্স উন্নয়ন করা হচ্ছে।

মামুন অর রশীদ বলেন, ইউনিকোড হলো লিখনপদ্ধতি বা লিপিগুলোর কম্পিউটারে ব্যবহার করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি কমন মান। পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষার লিপির জন্য কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রির বিজ্ঞানী, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম এই মান নির্ধারণ করে থাকে। তবে বাংলা ইউনিকোড চার্টে বাংলা ভাষার যথার্থ প্রতিফল ঘটেনি। এর ফলে বাংলা ডোমেইনের আইডিএন কার্যক্রম জটিলতার মধ্যে পড়েছে। ইউনিকোডের প্রথম সংস্করণ ১৯৮৮ সালে প্রকাশ পেলেও ১৯৮৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে বাংলাদেশ ছিল না। ফলে, বাংলা ইউনিকোড বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রদান করতেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও অন্য দেশের বিশেষজ্ঞেরা। ফলে, প্রথম সংস্করণ থেকেই ইউনিকোডে বাংলা ভাষার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলো যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি। বিশেষ করে ড়, ঢ়, য়, ৎ-কে বাদ দিয়ে চার্ট করা হয়, পরবর্তীকালে নোকতাযোগে লেখার পরামর্শ দিয়ে ড়, ঢ়, য়-কে অতিরিক্ত বর্ণ হিসেবে যোগ করা হয়, যা বাংলা ভাষার মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এমন আরও কিছু অসংগতি রয়েছে ইউনিকোড চার্টে।

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে বাংলা ভাষার এই বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়েছে। ২০১০ সালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এই কনসোর্টিয়ামে ভোটিং মেম্বার হিসেবে যোগ দেয়। বাংলা ইউনিকোডের উল্লিখিত অসংগতিগুলো কনসোর্টিয়ামে তুলে ধরার জন্য সরকার ও বিশেষজ্ঞমতের পাশাপাশি জনমত প্রয়োজন।

মামুন অর রশীদ বলেন, ‘ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যাতে আমাদের দাবি মানা হয়, তার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

বিশ্বজুড়ে ডোমেইনে আগ্রহ
বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ইন্টারনেট ডোমেইন নিবন্ধনের সংখ্যা। ২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের পর সর্বমোট নিবন্ধিত ডোমেইনের (টপ লেভেল ডোমেইন বা টিএলডিএস) সংখ্যা হয়েছে ৩৪ কোটি ২৪ লাখ। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ডোমেইন নেম ইন্ডাস্ট্রি ব্রিফ নামে নিবন্ধিত ডোমেইনের সংখ্যা প্রকাশ করেছে শীর্ষস্থানীয় ডোমেইন নাম ও ইন্টারনেট সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ভেরিসাইন। চতুর্থ প্রান্তিকে মোট ডোমেইন নিবন্ধন হয়েছে ২৬ লাখ, যা দ্বিতীয় প্রান্তিকের চেয়ে দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। বছরের হিসাবে ডোমেইন নাম নিবন্ধের হার সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে।

ভেরিসাইনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে মোট ‘ডটকম’ ও ‘ডটনেট’ টপ-লেভেল-ডোমেইন নিবন্ধন হয়েছে ১৫ কোটি ১৭ লাখ। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় যা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। বছরের হিসাবে তা ৪ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ডটকম ডোমেইন নিবন্ধন হয়েছে ১৩ কোটি ৭৬ লাখ আর ডটনেট নিবন্ধন হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ। নতুন ডটকম ও ডটনেট ডোমেইন নিবন্ধন হয়েছে ৯৫ লাখ, যা ২০১৭ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ছিল ৮৯ লাখ।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিএলজি বৃহত্তম টিএলডিগুলো হলো ডটকম ১৩৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন, ডটসিএন ২২ দশমিক ৭ মিলিয়ন, ডটটিকে ২১ দশমিক ৫ মিলিয়ন, ডটডিই ১৬ দশমিক ২ মিলিয়ন, ডটনেট ১৪ দশমিক ১ মিলিয়ন, ডটইউকে ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন, ডটওআরজি ১০ দশমিক ৩ মিলিয়ন, ডটআরইউ ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন, ডটএনএল ৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন, ডটইনফো ৫ মিলিয়ন।

টোটাল কান্ট্রি কোড টিএলডি বা সিসিটিএলডি নিবন্ধন হয়েছে ১৪ কোটি ৯৩ লাখ, যা বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় দশমিক ৫ মিলিয়ন কম। শীর্ষ সিসিটিএলডিগুলো হচ্ছে ডটসিএন, ডটটিকে, ডটডিই, ডটইউকে, ডটআরইউ, ডটএনএল, ডটবিআর, ডটইইউ, ডটএফআর ও ডটএইউ।

নতুন জিটিএলডির ক্ষেত্রে অবশ্য বেশ আগ্রহ বেড়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৩৮ লাখ নতুন জিটিএলডিএস নিবন্ধিত হয়েছে, যা দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় সাড়ে ৭ শতাংশ বেশি। নতুন জিটিএলডির মধ্যে ডটটপ, ডটলোন, ডট এক্সওয়াইজেড, ডটক্লাব, ডটঅনলাইন, ডটভিআইপি, ডটউইন, ডটএলটিডি, ডটশপ, ডটসাইট উল্লেখযোগ্য।