শীতের মাথা গরম কেন?
খবর: আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৬ দিনের তাপমাত্রার যে তথ্য রয়েছে, তার চিত্র অন্য বছরের শীতের সঙ্গে বেমানান। সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরের হিসাবে ডিসেম্বরে দেশে গড় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম ছিল। এবারের ডিসেম্বরে সেই তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬) লেখা: মোস্তফা মনোয়ার ও শরীফ মজুমদার
শীতের গান-কবিতার অভাব
কবি বলেছেন, ‘সবুজ পাতার খামের ভিতর হলুদ গঁাদা চিঠি লিখে, কোন পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে...।’ এই যে এত কায়দা-কসরত করে চিঠিটিঠি লিখে হেমন্তকে ডেকে ডেকে, সেধে সেধে আনলেও শীতের কাছে কেউ কোনো দিন না লিখেছে চিঠি, না লিখেছে আমন্ত্রণপত্র। ‘শীত আসে না ক্যান’, ‘শীত আসে না ক্যান’ বলে যত মায়াকান্না সব মুখেই। এ ছাড়া জগতের সব সুন্দর জিনিস নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিরা, গান গেয়েছেন শিল্পীরা। ভাত থেকে শুরু করে সমুদ্র—কোনো কিছুই বাদ নেই। আবার বর্ষা, কিংবা বসন্ত নিয়েও কবি-সাহিত্যিকেরা এন্তার সাহিত্য রচনা করেছেন, কবিতা লিখেছেন, গীতিকারেরা গান লিখেছেন কতশত! অথচ অন্যতম প্রধান ঋতু হলেও শীতকে নিয়ে গান-কবিতা খুঁজেই পাওয়া যায় না। শীতকালের প্রতি শিল্পী-কবিদের এ কেমন বিরূপ আচরণ! শীতের মাথা গরম হওয়া কি
যৌক্তিক নয়?
নেতিবাচক ইমেজ
‘হাড়কাঁপানো শীত’, ‘কনকনে ঠান্ডা’, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়েও লাগে’, ‘উফ্, শীতের
কী দাপট’
টাইপের অনেক নেগেটিভ কথাবার্তা শীতকে নিয়ে বলা হয়।
এ নিয়ে ঋতুসমাজে শীতের একটি নেতিবাচক
ইমেজ তৈরি হয়েছে। মানবসমাজের এহেন আচরণে শীতের মাথা গরম হলে
কিই–বা বলার থাকতে পারে?
দেরি করলেই শীতের দোষ
শীত ডিসিপ্লিন খুব পছন্দ করে। সে প্রতিবার নিয়ম করে আসে, নিয়ম করে চলে যায়। অথচ আমরা অফিসে কিংবা ক্লাসে দেরি করে গিয়ে ভাঙাই শীতের নাম! এ কেমন আচরণ! শীত আমাদের আরাম করে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেয়, সন্দেহ নেই। তাই বলে এমন নেমকহারামি কি মানায়? তাই এবার শীতের মাথা গরম, যাতে করে কেউ আর তার নাম ভাঙিয়ে খেতে না পারে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন একসঙ্গে ‘চলার’ কারণে বাঙালির ‘যাহা ছয়টা তাহাই নয়টা’ অর্থাৎ ‘লেট সংস্কৃতি’ শীতও ধরে ফেলেছে! তাই হেমন্ত শেষ হওয়ার আগেই চলে আসার কথা থাকলেও শীত ঠিক করেছে এখন থেকে ‘লেট’ করে, রয়েসয়েই আসবে।
বিরূপ আচরণ
এই যে ‘শীত কম শীত কম’ বলে হাহাকার, মানুষজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তার একটা কারণ অতিথি পাখি কমে যাওয়া। শীতের অতিথি পাখিদের সঙ্গে আমাদের আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয়! নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা অতিথিদের প্রতি এমন বিরূপ আচরণের কারণেও শীতের মাথা গরম। আপনি বলুন, আপনি যদি সঙ্গে করে অতিথি আনেন আর আমরা সেই অতিথিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, আপনার মাথা গরম হবে না?
কেউ বরণ করে না
বৈশাখের শুরুতেই সবাই ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ বলে কী সুন্দর সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে গান গেয়ে ওঠে। কিন্তু মুখে মুখে এত আদিখ্যেতা দেখালেও শীতের শুরুতে কেউ কখনো ‘এসো এসো’ বলেছে? বলেনি। শীতকাল কি এতই ফেলনা? শীত কি আমাদের কিছুই দেয় না? এই যে পিঠা খাই আমরা, শীতের সবজির কথা তো বলাই হলো। এগুলো কি কিছুই না? হ্যাঁ, শীত এলে আমরা পিঠা খাই, সেই পিঠা নিয়ে উৎসব করি। কিন্তু শীতকে আমন্ত্রণ জানাতে কোনো উৎসব নেই। এসব কারণে শীত অপমানিত বোধ করছে। তাই সে মাথা গরম করে আছে। এবং কেউ তার মান ভাঙানোর চেষ্টা পর্যন্তও করছে না!
ডেকে এনে অপমান
দীর্ঘদিনের ‘পূর্ব অভিজ্ঞতায়’ শীত দেখেছে যে আসার আগে মানুষের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও পরে ঘটনা অন্য রকম হয়ে যায়। আসতে না আসতেই মানুষজন লেপ, তোশক, কম্বল, সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, হাত মোজা, পা মোজা, কান মোজা ইত্যাদি
ইত্যাদি গায়ে, মাথায়, হাতে, পায়ে, কানে পরে শীত প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করে। শীতের কাছে মনে হয়েছে, এটা ডেকে এনে অপমান করা বই আর কিছু নয়।
শীতকালীন সবজি নিয়ে চেকইন
পত্রপত্রিকায় হাহাকার চলছে, শীতের অভাবে নাকি শীতকালীন সবজির চাষ হচ্ছে না ঠিকমতো। এ রকম আদিখ্যেতা আর হয়? শীতকালীন সবজির কথা বলতেই তো লজ্জা লাগা উচিত। কেউ তো কোনো দিন শীতকালীন সবজিকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। তাহলে এখন শীতকালীন সবজি নিয়ে এমন হাহাকারের মানেটা কী? সবাই তো বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় মুরগিটুরগি খেয়েই চেকইন দেয়। কেউ তো কোনো দিন, ইটিং আলু, ইটিং শিম এসব লিখে চেকইন দিল না। তাহলে এখন আবার শীতকালীন সবজির কথা বলার মতো আদিখ্যেতা দেখানোর তো কোনো মানে হয় না। এ জন্যই শীতের মাথা গরম হয়ে গেছে। সে তার প্রাপ্য সম্মান তো
পায় না।