'কান্দন তো আছেই ওর কপালে'

মেয়ে জান্নাতকে কোলে নিয়ে সাথী ষ ছবি: সুচিত্রা সরকার
মেয়ে জান্নাতকে কোলে নিয়ে সাথী ষ ছবি: সুচিত্রা সরকার

ঘরের মাঝখানে কাঠের চৌকি। বাকি আসবাব বলতে রয়েছে একটি টিনের পুরোনো মিটসেফ। চৌকিতে ঘুমিয়ে আছে একটি শিশু। আর দোরগোড়ায় একটি কিশোরী মেয়ে পান্তাভাত খাচ্ছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। শিশুটিও কেঁদে উঠল। কিশোরী মেয়েটি বাকি ভাতটুকু না খেয়েই হাত ধুয়ে কোলে তুলে নিল শিশুটিকে। শিশুটি এই কিশোরী মেয়েটির সন্তান।
এই কিশোরী মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ৩ জুলাই সকালে কামরাঙ্গীরচরের মালেক কলোনিতে যাই। কিশোরীর নাম সাথী আক্তার। দেখলেই বোঝা যায়, তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করো?
সাথী বলে, ‘কাগজ টুকাই। গাউসিয়া, চাঁদনী চক মার্কেটের দোকানে দোকানে গিয়া ঠোঙা, কাগজের বাক্স টুকাই। তারপর সেগুলা চরে আইন্যা ভাঙারির দোকানে বেচি।’
বিক্রি করে কত টাকা পাও? একটু চিন্তা করে। তারপর বলে, ‘এই ধরেন সপ্তাহে পাঁচ শ টেকা, সাত শ টেকা।’
তোমার স্বামী কী করে?
‘লোহার দোকানে কাম করে। মাসে পাঁচ হাজার টেকা পায়।’
তারপর বলতে থাকে তার নিজের রোজনামচা। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে থালাবাসন মাজে। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করে রান্না বসায়। এর ফাঁকে বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে নেয়।
ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাচ্চার বয়স কত?
‘পাঁচ মাস। আমার শাশুড়ি ওর নাম রাখছে জান্নাত।’
তারপর আবার আগের কথায় ফিরে আসে। বলে, ‘রান্ধা শেষ হইতে হইতে একটা বাজে। ভাত খাইয়া কাগজ টুকাইতে বাইর হইতে হইতে দুইটা বাজে। ’
কথায় কথায় সাথী বলে তার জীবনকাহিনি। ওর বাচ্চা এখন দুধ খায়। তাই ও কাগজ খুঁজতে গেলে মেয়েকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর সঙ্গে যায় ওর শাশুড়ি। তিনি জান্নাতকে নিয়ে নিউমার্কেট ওভারব্রিজের নিচের সড়কদ্বীপে বসে থাকেন। আর একটু পরপর সাথী সেখানে এসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়। বলে, ‘মার্কেটে কাগজ টুকাইতে এক চক্কর দিই। তারপর মাইয়ারে দুধ খাওয়াই। যহন বেশি কান্দে তহন শাশুড়ি অন্য টোকাইগো কাছে খবর পাঠায়। তহন আবার দৌড়াইয়া আসি।’
কতক্ষণ কাগজ টোকাও?
‘রাত ১১টা পর্যন্ত। তারপর কাগজ বেশি হইলে রিশকা কইরা আসি। আর কম হইলে হাঁটতে হাঁটতে আসি। তখন মাথায় কইরা আনি।’
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি স্কুলে পড়েছ?
‘না।’ অকপট উত্তর। ‘স্কুলে যাইতে ভালা লাগত না। দুই-তিন দিন গেছি।’
এত কম বয়সে বিয়ে হলো কেন তোমার?
‘আমার স্বামীরও তো বয়স কম। ২০ বছর। সবাই তো কয়, গরিবের মাইয়ার তাড়াতাড়িই বিয়া হয়। দেরি করন ঠিক না। আমার তো বাপ নাই। এর লাইগ্যা মায় বিয়া দিছে।’
কিন্তু এত কম বয়সে বাচ্চা নিলে কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘আমি তো কিছু বুঝি নাই। বাচ্চা হওনের পাঁচ মাস আগে সবাই কইছে। তহন বুঝছি। আর ও হইছে সাত মাসে। অনেক ছোট্ট হইছে।’
ও হওয়ার সময় তোমার কোনো সমস্যা হয়নি?
‘অনেক কষ্ট পাইছি। বাড়িতেই হইছে। বাড়িতে দাই আইছিল। তারপর পাঁচ দিন পরে বাচ্চার অনেক জ্বর হইছিল আর ঠান্ডা লাগছিল। তখন একটা হাসপাতালে ভর্তি হইছিলাম। ওইখানে কুন টেকাপয়সা লাগে নাই। ডাক্তারে কইছে, বাচ্চা যত দিন দুধ খাইব, তত দিন আমার ভালা ভালা খাইতে হইব।’
কী খাবার খাও তুমি?
‘শরীলে রক্ত হওনের লাইগ্যা কালিজিরা ভর্তা, আলু ভর্তা খাইছি। সবাই কয়, পোলাপান হইলে ভর্তা দিয়া ভাত খাইলে রক্ত বাড়ে। আর এখন যেসুম যা পাই, তাই খাই।’
আজ দুপুরে কী খাবে?
প্রশ্নটা যেন তাকে অপ্রস্তুত করে তোলে। বলে, ‘আইজ হরতাল। কামে যামু না। আমার স্বামীও কামে যাইব না। কিছু নাই ঘরে। কী রান্ধুম? এখন তো পান্তা খাইছি পেট ভইর‌্যা। সারা দিন আর কিছু না খাইলেও চলব।’
কিন্তু তোমার মেয়ে তো দুধ খাচ্ছে, এখন তো তোমার বেশি খাওয়া উচিত?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘কেমনে খামু। এত টেকা পামু কই। আর গবিরের ঘরে জন্মাইছে, কান্দন তো ওর কপালে আছেই।’