মুক্তাগাছার ফ্রিল্যান্সার হাসানুল নিজে হাঁটতে না পারলেও গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান, কর্মীসংখ্যা এখন ৫৩

হাসানুল ইসলামসংগৃহীত

২০২২ সালের ১২ অক্টোবর কথা হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার হাসানুলের সঙ্গে। এর কদিন পর প্রথম আলোয় ‘শরীর চলে না, তবুও ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল মুক্তাগাছার হাসানুল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি বেশ সাড়া জাগায়। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল হাসানুলের সঙ্গে। একজন কর্মী হাসানুলকে কাঁধে করে নিয়ে এলেন সম্মেলনক্ষের বাইরে। বোঝাই গেল শারীরিকভাবে এখনো ঠিক নন হাসানুল।

জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসানুল ইসলাম
প্রথম আলো

হাসানুল জানালেন, এখন তাঁর টেক্সা জিনি নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। যেখানে কাজ করছেন প্রায় ৫৩ জন। আর হাসানুল টেক্সা জিনির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ঢাকায় ১৯ জন কর্মী নিয়ে এসেছেন জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে যোগ দিতে।
মুক্তাগাছাতেই হাসানুল ইসলামের অফিস। সেখানে বসেই বিদেশি গ্রাহকদের আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দিচ্ছেন। হাসানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সারস সম্মেলনে আসার একটাই কারণ—নেটওয়ার্কিং। এখানে সারা দেশ থেকে ভালো ভালো উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সার এসেছেন। তাই আমি আমার দলের একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। যাতে তারাও বুঝতে পারে আমাদের অবস্থানটি। এ ছাড়া এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও আছে আমার প্রতিষ্ঠান।’

ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতা পাওয়ার পর উদ্যোক্তা হয়েছেন হাসানুল। তিনি মূলত ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করেন। এর মধ্যে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) এবং অনলাইন রিসেপশন ম্যানেজমেন্ট (ওআরএম) নিয়ে বেশি কাজ করে টেক্সা জিনি।  

আরও পড়ুন

জটিল রোগ এবং...

‘সালটা ২০১৬। দিন দিন আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। কী করব, কোথায় যাব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবে জীবন শুরু, কত স্বপ্ন, কত কিছু করার ইচ্ছা—ধীরে ধীরে সব শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা জেদ চেপে বসল। যত কষ্ট হোক কিছু একটা আমি করব। প্রথম আলোর বিভিন্ন ফিচার পড়তাম, অনুপ্রেরণা পেতাম। ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং নিয়ে যত ধরনের লেখা ছাপা হতো প্রথম আলোয়, সেগুলো পড়তাম। মনে মনে চিন্তা করে ফেললাম এর চেয়ে ভালো কাজ আর নেই। আমার মতো শারীরিক অক্ষম মানুষের জন্য উপযোগী।’ বললেন হাসানুল।

আরও পড়ুন

২০১৪ সালে মুক্তাগাছার শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজে মার্কেটিংয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন হাসানুল। ক্রিকেট খেলতেন নিয়মিত। দৈনিক পত্রিকার তথ্যপ্রযুক্তি পাতাগুলোর নিয়মিত পাঠক ছিলেন। হাসানুলের বাবা মো. আমিনুল ইসলাম পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। ২০১১ সালে গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। তার পর থেকে একটু একটু করে সরে আসেন তাঁর পেশা থেকে। হাসানুল সবার বড় সন্তান। বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্বও বেশি। তখন থেকেই হাসানুলের চিন্তা—জীবনে অনেক বড় হতে হবে।

এদিকে হঠাৎ হাসানুলের শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। তিনি কঠিন এক স্নায়ুরোগ মাইওপ্যাথিতে আক্রান্ত হন। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ে। এর মধ্যেও ফ্রিল্যান্সিং শেখার আগ্রহে ভাটা পড়ে না। তবে ভালোভাবে শেখার কোনো জায়গা পান না। একদিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে নিজেকে গোছাতে থাকলেন। হাসানুল বলেন, ‘যখন যে যেটা করতে বলত, তখন তা-ই করতাম। ইউটিউব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মার্কেটপ্লেস (ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আউটসোর্সিং কাজ পাওয়ার ওয়েবসাইট) ঢুকে দেখতাম।’

আরও পড়ুন

এমনই অসুস্থ হয়েছিলেন হাসানুল যে হাঁটাচলা করতে পারতেন না। এটা ২০১৬ সালের কথা। এক চেয়ার থেকে আর এক চেয়ারে গিয়ে বসতেও অন্যের সহায়তা নিতে হতো হাসানুলের। কোনোভাবেই নিজেকে বোঝাতে পারেন না, তাঁর জীবন এখানেই থেমে যাবে। কিন্তু কিছু একটা করার জেদ সব সময় কাজ করত। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তাঁর দায়িত্ব অনেক। জেদ ধরে কম্পিউটার নিয়েই পড়ে থাকলেন হাসানুল।

ইচ্ছাশক্তির জোরে

হাসানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে শারীরিক অসুস্থতা কোনো অক্ষমতা নয়, মন সুস্থ থাকলে সব সুস্থ। সবচেয়ে বড় কথা, মনে সাহস থাকতে হবে।’ যদি ধৈর্য আর দক্ষতা বাড়াতে পারে কেউ, তবে আমার মতো শারীরিকভাবে যাঁরা অক্ষম, তাঁরা সহজেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজটি করতে পারেন।

আরও পড়ুন

শারীরিক অবস্থা যখন নাজুক, তখন ইন্টারনেট-সংযোগের মাসিক খরচ দেওয়াও মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। মা-বাবা বললেন, কিছু হবে না, বাদ দাও। তখনো জেদ ধরে রাখলেন হাসানুল। এদিকে পড়াশোনাও করতে হচ্ছে। বন্ধুরা ধরে ধরে শুধু পরীক্ষার সময় তাঁকে নিয়ে যেতেন কলেজে। ২০১৭ সালে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার মার্কেটপ্লেস ফাইভআরে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন হাসানুল। তারপর দিনের পর দিন চেষ্টা করতে থাকেন নিজে নিজেই। একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যদিও গিয়েছিলেন হাসানুল, কিন্তু কাজ করার মতো কিছু শিখতে পারেননি।

২০২০ সালে সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি) অধীনে ময়মনসিংহ জেলায় বিনা মূল্যের এক প্রশিক্ষণের খবর পান হাসানুল তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে। হাসানুল আবেদন করেন। পরীক্ষায় টিকে গিয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ। প্রায় চার মাসের প্রশিক্ষণে মোট ২০০ ঘণ্টার ৫০টি ক্লাস করেন। ডিজিটাল বিপণনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে হাসানুল ফাইভআরে পেয়ে যান ৪০ ডলারের একটি কাজ। তখন তাঁর ভালো লাগাটা ছিল আকাশছোঁয়ার মতো। হাসানুলকে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এর বছরখানেক আগে টেক্সা জিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসানুল। ফ্রিল্যান্সার থেকে হয়েছেন উদ্যোক্তা। স্থানীয় তরুণদের কর্মসংস্থান করেছেন নিজের প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু এখনো শারীরিকভাবে অসুস্থ হাসানুল। স্নায়ুরোগটির কারণে নিজে হাঁটাচলা করতে পারেন না। কারও সহযোগিতা নিয়ে যেতে হয় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে হাসানুল ইসলাম অন্যদের সহযোগিতা করছেন, নিজের প্রতিষ্ঠানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।