মেড ইন বাংলাদেশ

সীতাকুণ্ডের ভহরপুর গ্রামের বড় বাড়ি এলাকায় এই নারীদের হাতে তৈরি টুপি রপ্তানি হয় ওমানে    ছবি: সৌরভ দাশ
সীতাকুণ্ডের ভহরপুর গ্রামের বড় বাড়ি এলাকায় এই নারীদের হাতে তৈরি টুপি রপ্তানি হয় ওমানে ছবি: সৌরভ দাশ

২০০২ সালের কথা। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার শায়েরখালী গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম নগরে এসে ঠাঁই গাড়েন কাজী সেলিম। ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাবেন। তাই নগরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিন বছর মেয়াদি একটি কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হন। এক বছর লেখাপড়ার পর ক্রেডিট স্থানান্তর করে আয়ারল্যান্ডে যেতে ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সির সহযোগিতা নেন সেলিম। এ জন্য দুই লাখ টাকাও জমা দেন। কিন্তু ভিসা পেতে ব্যর্থ হন। এরপর হতাশা পেয়ে বসে তাঁকে।এমন সময় ২০০৩ সালের শুরুতে ছুটিতে ওমান থেকে দেশে আসেন সেলিমের মেজ ভাই কাজী রবিউল। ছোট ভাইয়ের হতাশা দেখে তাঁকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজে কিছু করার পরামর্শ দেন। ওমানে থাকা অবস্থায় টুপিতে সুতার কাজ শিখেছিলেন রবিউল। ওই দেশে নকশা করা টুপির চাহিদাও বেশ। ভাইকে নিজ হাতে শেখান সেই কাজ।কাজী সেলিমও তখন মরিয়া। কিছু একটা আঁকড়ে ধরে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছিলেন। শায়েরখালী গ্রামের কনিকা, মনোয়ারা, পারুল, নাসু, শামীমা ও গানসু নামের ছয়জন গৃহিণীকে টুপিতে নকশা তোলার কাজ করতে দেন। সবাই মিলে তৈরি করে দেন ২০টি টুপি। সেগুলো রবিউলকে দিয়ে ওমানে পাঠান। ভালো দামেই বিক্রি হয় কাজী সেলিমের টুপি। এভাবে শুরু ‘কাজী ক্যাপ হাউজের’ যাত্রা। আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, মিরসরাইয়ের পাশাপাশি কক্সবাজারের চকরিয়া ও রামুর গ্রামের নারীরাও এখন সেলিমের জন্য টুপি তৈরি করেন, যে নারীরা দিনের সময়ের পুরোটাই ব্যয় করতেন ঘরকন্নার কাজে।

গ্রামে গ্রামে টুপির কারিগর: সাড়া পেয়ে উৎসাহ বেড়ে যায় সেলিমের। পুরো উদ্যমে লেগে যান টুপি তৈরির কাজে। নিজ গ্রামের পাশাপাশি মিরসরাই উপজেলার বিশ্ব দরবার, সৈদালী ও ডাকবাংলা গ্রামের নারীদেরও যুক্ত করেন টুপি তৈরিতে। সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সীতাকুণ্ড উপজেলার গ্রামেও ছড়িয়ে দেন টুপির কাজ। একে একে সীতাকুণ্ডের ভহরপুর, ঢালীপাড়া, ঘোড়ামারা, ফকিরহাট, বাড়বকুণ্ড ও কুমিরার গৃহিণীরা শেখেন টুপি তৈরির কাজ।

সেলিমের কর্মীদের টুপি তৈরির কাজ দেখতেই সীতাকুণ্ডের প্রত্যন্ত ভহরপুর গ্রামে যাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পশ্চিমে প্রায় তিন কিলোমিটার বেহাল রাস্তা পেরিয়ে ভহরপুর গ্রামের বড়বাড়ি এলাকা। এখানকার গৃহিণী রাশিদা বেগম ২০০৩ সাল থেকেই সেলিমের জন্য টুপি তৈরি করছেন।

রাশিদার উঠানেই দল বেঁধে আটজন নারী টুপিতে সুতার কাজ করছেন। শুরুর কথা জানতে চাইলে রাশিদা বলেন, ‘একদিন সেলিম ভাই এসে টুপিতে নকশা তুলতে বললেন। তিনিই শিখিয়ে দিলেন কীভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমে শুধু ছয়টি টুপিতে কাজ করতে দিয়েছিলেন।’

রাশিদা জানান, ভহরপুর গ্রামের প্রায় ১০০ নারী এখন টুপি তৈরির কাজ করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী রাশিদা বলেন, ‘টুপির কাজ করায় আমার হাতে কিছু টাকা আসে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আর ঘরের জিনিসপত্র কিনতে এসব টাকা খরচ করি।’

একটি টুপিতে নকশা করে সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ সাতশ টাকা পান একজন নারী। এক মাসে একজন নারী সর্বোচ্চ চারটি টুপি তৈরি করতে পারেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামে আছে কাজী ক্যাপ হাউজের বিশাল কর্মী বাহিনী। কাপড় ও সুতা বুঝিয়ে দেওয়া এবং কাজ শেষে টুপি ফেরত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ১৫ জন লোক নিয়োগ করেছেন সেলিম। এই মধ্যস্থতাকারীরা টুপিপ্রতি পান ৫০ টাকা।

কাজী সেলিম বলেন, ‘কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারী টুপি তৈরির কাজ করেন। তবে একটি টুপি তৈরিতে সর্বনিম্ন সাত থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। ঘরের কাজের ফাঁকে গৃহিণীরা এ কাজ করেন। তাই মাসে এক থেকে দেড় হাজারের বেশি টুপি তৈরি করা সম্ভব হয় না।’

মেড ইন বাংলাদেশ: টুপি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় জাপানি কাপড় ও ভারতীয় সুতা। কাপড় ও সুতা কিনে নকশার নমুনা দিয়ে গ্রামের নারীদের কাজ বুঝিয়ে দেন সেলিম। তারপর শুরু হয় কাজ। গোল, হাফ ও রেশমি টুপিতে নকশা ফুটে ওঠে নানা রঙের সুতায়। টুপির ছাউনির অংশেও করা হয় নকশা। তারপর ছাউনির অংশ ঘেরের সঙ্গে সেলাই করে দেওয়া হয়।

একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওমানের সালালা শহরে পাঠানো হয় এসব টুপি। সেখানে কাজী সেলিমের প্রবাসী তিন ভাই বাকি কাজ করেন। সেলাই খুলে ছাউনির অংশ নতুন করে সেলাই করা হয়। তারপর ধুয়ে লাগানো হয় ট্যাগ। এতে লেখা থাকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’।

কাজী সেলিম বলেন, ‘বাংলাদেশের নাম যাতে ছড়িয়ে পড়ে, সে জন্য মেইড ইন বাংলাদেশ লিখে দিই। সালালায় ঘুরতে আসা পর্যটকেরাও এসব টুপি কেনেন। তাঁদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের টুপির সুনাম।’

সেলিম জানান, একটি টুপির কাঁচামাল, মজুরি ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা খরচ পড়ে। মাসে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার টুপি ওমানে পাঠাই। বিক্রির পর এতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়। তবে দুই ঈদে টুপির চাহিদা বেড়ে যায়।

স্বপ্ন এখন সীমানা ছাড়ানোর: সীতাকুণ্ডের টেরিয়াইল, শেখেরহাট, ভহরপুর, মহানগর এলাকায় নারীদের মধ্যে টুপি তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ এবং তৈরি টুপি বুঝে নেওয়ার কাজ করেন জাফর আহমদ। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৭০০ জন আমার অধীনে কাজ করে। কৃষিকাজ করি। পাশাপাশি এ কাজ করে সচ্ছলতা এসেছে।’

কাজী সেলিমের স্বপ্নও গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষদের সচ্ছল করে তোলা। তাঁর কাছে জানতে চাই, ‘এখন কি বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন?’ উত্তরে তিনি হেসে বলেন, ‘বিদেশে যাওয়ার আর দরকার নেই। এই কর্মীদের ছেড়ে যেতেও পারব না। ব্যবসার পাশাপাশি গ্রামের স্বল্প আয়ের নারী-পুরুষ সচ্ছল হচ্ছেন, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। আরও বেশি মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে চাই। স্বপ্ন দেখি তাঁদের হাতে তৈরি টুপি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যাবে।’