উইন্ডোজ ফোন ছেড়ে দেন: মাইক্রোসফট

যাঁরা উইন্ডোজ ১০ মোবাইল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন তাদের ওই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখন যাঁরা উইন্ডোজ মোবাইল প্ল্যাটফর্মের উইন্ডোজ ফোন ব্যবহার করছেন তারা আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে চলে যেতে পারেন। মাইক্রোসফট সমর্থিত সাপোর্ট পেজে ওই তথ্য জানানো হয়েছে।

মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে উইন্ডোজ ১০ মোবাইল প্ল্যাটফর্মে বিনা পয়সায় আর কোনো নিরাপত্তা আপডেটসহ সমর্থন দেওয়া হবে না। এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের বিকল্প খুঁজতে হবে।

সাপোর্ট পেজে মাইক্রোসফট শুক্রবার বিবৃতিতে বলেছে, উইন্ডোজ ১০ ওপারেটিং সিস্টেম মোবাইলে সমর্থন বন্ধ হচ্ছে। গ্রাহকদের অনুরোধ করছি, আপনারা অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে অ্যান্ড্রয়েড বা আইওসে চলে যান। আমাদের যেসব মোবাইল অ্যাপস রয়েছে সেগুলো যাতে অন্যান্য প্লাটফর্মেও কাজ করে সেভাবেই প্রস্তুত করেছি।

মাইক্রোসফট বলছে, এখন থেকে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট করটানা এখন থেকে অ্যামাজনের অ্যালেক্সা এবং গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করবে না। এর পরিবর্তে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে করটানার সেবা পাওয়া যাবে।

মাইক্রোসফটের লক্ষ্য হচ্ছে-পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মোবাইল অ্যাপস, ও বিভিন্ন ডিভাইস প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমর্থন দেওয়া।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে এখন অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোন প্ল্যাটফর্মে সফটওয়্যার সেবা দেওয়ার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে। মাইক্রোসফট দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামস্যাংয়ের সঙ্গে চুক্তি করে অফিস সফটওয়্যার যুক্ত গ্যালাক্সি ফোন বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে মোবাইল ডিভাইসে উইন্ডোজ সফটওয়্যার নিয়ে বিশাল পরিকল্পনা করেছিল বিশ্বের বৃহত্তম সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সালে অপারেটিং সিস্টেমে বিশাল হালনাগাদ করে উইন্ডোজ ফোন ৭ বাজারে এনেছিল। ওই সময় মাইক্রোসফট ঘোষণা দিয়েছিল, ব্ল্যাকবেরি ও আইফোন মারা যাবে। মাইক্রোসফট ওই সময় নকিয়াকে অধিগ্রহণও করেছিল। কিন্তু ৭ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারে নকিয়াকে অধিগ্রহণ করার পরেও মাইক্রোসফটের ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

উইন্ডোজ ফোন ব৵র্থ হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এর প্রধান কারণ হল, অ্যাপের স্বল্পতা। অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোনের জনপ্রিয় অ্যাপগুলো এ প্ল্যাটফর্মে আনতে পারেনি মাইক্রোসফট।

গত বছরের মার্চ মাসে উইন্ডোজ ফোন বিভাগের সাবেক প্রধান টেরি মেয়ারসন বিষয়টি খোলসা করেন। তিনি বলেন, অ্যান্ড্রয়েডের মতো বিশাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অবস্থা উইন্ডোজ ফোনের ছিল না।

২০০৭ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপল যখন প্রথম আইফোন বাজারে ছাড়ে, তখন মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বলমার দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন, ফোনের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করার কোনো সম্ভাবনা আইফোনের নেই। বলমার তখন গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার বিষয়টিতে এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, মোবাইল ডিভাইসে অ্যান্ড্রয়েড যে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে, তা তিনি ধরতে পারেননি।

যখন আইফোন বাজারে আসে, তখন পর্যন্ত মোবাইল বাজারে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল মাইক্রোসফটের। ওই সময় উইন্ডোজ মোবাইলকে স্মার্টফোনের অন্যতম অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে গণ্য করা হতো। তবে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত মাল্টিটাচ মোবাইল ওএস হিসেবে কোনো অপারেটিং সিস্টেম ছাড়েনি মাইক্রোসফট। অর্থাৎ, প্রথম আইফোন বাজারে ছাড়ার তিন বছর ও প্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন বাজারে আসার দুই বছর পরে মাইক্রোসফট যুদ্ধে নামে।

কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেই স্মার্টফোনের বাজার আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড-এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ডেভেলপাররা উইন্ডোজ ফোনের জন্য অ্যাপ তৈরিতে কোনো লাভ দেখতে পায়নি। জনপ্রিয় অ্যাপ না থাকায় উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি স্মার্টফোন ক্রেতারা। ডেভেলপারদের নানা সুবিধা দিয়ে জনপ্রিয় অ্যাপগুলো উইন্ডোজ ফোনে আনার মরিয়া চেষ্টা চালায় মাইক্রোসফট। কিন্তু যে গতিতে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড এগিয়েছে, তার চেয়ে মাইক্রোসফটের গতি ছিল ধীর। ফলে মাইক্রোসফট শুধু পিছিয়েছে।

স্মার্টফোন নির্মাতারা অ্যান্ড্রয়েডের বিকল্প হিসেবে উইন্ডোজ ফোনকে শুরুতে বিবেচনা করলেও পরে এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ২০১৪ সালে ৭২০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে ফিনল্যান্ডের মোবাইল ফোন নির্মাতা নকিয়াকে অধিগ্রহণ করে মাইক্রোসফট। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাইক্রোসফটের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। বিশাল হার্ডওয়্যার বিভাগ চালানোর ভার বহন করলেও উইন্ডোজ ফোন বিক্রি সামান্য বাড়ে।

ওই সময়ে স্টিভ বলমারের কাছ থেকে মাইক্রোসফটের ভার বুঝে নেন সত্য নাদেলা। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে ছিল মাইক্রোসফটের হ্যান্ডসেট ব্যবসাকে বাদ দেওয়া। তিনি ওই সময় ৭ হাজার ৮০০ কর্মী ছাঁটাই করেন।

২০১৫ সালে উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেমের ঘোষণা দেয় মাইক্রোসফট। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, উইন্ডোজ ফোন ৮ এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্ট ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস কেবল উইন্ডোজ ১০ মোবাইল ওএসে চলাবে। এটি কন্টিনিয়াম ফিচার ও ডিসপ্লে ডকের মাধ্যমে ফুল ডেস্কটপ পিসিতে রূপান্তর করা যাবে। ব্যবসায়ী গ্রাহকদের জন্য এটি দারুণ ধারণা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে দুটি কারণে কন্টিনিয়াম সফলতা পায়নি। একটি হচ্ছে হাই এন্ড বা দামি উইন্ডোজ ডিভাইসের জন্য অনেকেই আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ছাড়তে চাননি। আরেকটি হচ্ছে অল-ইন-ওয়ান কম্পিউটিং ডিভাইসের ক্রেতা কম।

পিসির বাজার মাইক্রোসফট যেভাবে দখল করতে পেরেছে, তা মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে পারেনি।

অপারেটিং সিস্টেম ও হার্ডওয়্যারে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে মাইক্রোসফট সফটওয়্যারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েডের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মের ওপর ভর দিয়েই নিজেদের ক্লাউড সেবার ইকোসিস্টেম বাড়াতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। তথ্যসূত্র: সিএনবিসি, গার্ডিয়ান।

আরও পড়ুন: