কংক্রিটের জঙ্গলে নতুন আশা দেখাচ্ছেন গবেষকেরা

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল বিজ্ঞানী এমন এক ধরনের কংক্রিট তৈরি করেছেন, যা জীবন্ত সত্তার মতো কাজ করবে। পুনরুৎপাদনে সক্ষম এ কংক্রিট নির্মাণ খাতে এক বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে। পরিবেশবান্ধব এ কংক্রিট সব অর্থেই ‘সবুজ’।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল বিজ্ঞানী এমন এক ধরনের কংক্রিট তৈরি করেছেন, যা জীবন্ত সত্তার মতো কাজ করবে। পুনরুৎপাদনে সক্ষম এ কংক্রিট নির্মাণ খাতে এক বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে। পরিবেশবান্ধব এ কংক্রিট সব অর্থেই ‘সবুজ’।

প্রাণহীন, রূঢ় শুধু নয়, প্রাণের বিপরীত বাস্তবতার উপমা হিসেবে সারা বিশ্বের কবি ও শিল্পীরা বরাবরই ইট-কাঠ-পাথরকে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যে নগরসভ্যতার সূচনা হয়েছিল এবং যা আরও আরও সবেগে ছুটে চলেছে অজানা ভবিষ্যতের দিকে, তার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কবিদের এ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। সেই কবেই কিংবদন্তি শিল্পী বব মার্লে লিখে গেছেন, গেয়ে গেছেন তাঁর গান ‘কংক্রিট জঙ্গল’। সেই গানে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন নগরজীবনের ভয়াবহ বাস্তবতার কথা।

বব মার্লে বলছেন, ‘আমার আকাশে আজ সূর্য উঠবে না/ সুদূর ওই হলদে চাঁদের দেখা মিলবে না।’ শুধু বব মার্লে কেন ইট-পাথর ও কংক্রিটের নিষ্প্রাণ কাঠামোয় জেরবার হয়ে দু ছত্র লেখেননি এমন কবি আধুনিক যুগে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গান, কবিতা, উপন্যাস, চিত্রকলা থেকে শুরু করে শিল্পের সব মাধ্যমেই এমন প্রশ্ন, নগর কাঠামো নিয়ে এমন হতাশার কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন কবি-শিল্পীরা। এমন নয় যে, নগরে সূর্যালোক পৌঁছায় না, দেখা দেয় না চাঁদ। দেয়, আলবৎ দেয়। কিন্তু নিষ্প্রাণ এই কাঠামোয় চাঁদ ও সূর্যের এ পরিক্রমণ কোনো অর্থ যোগ করে না। আর এখানেই আপত্তি কবিদের, আপত্তি শিল্পীদের, আপত্তি যেকোনো অনুভূতিপ্রবণ মানুষের। সুখের বিষয় হচ্ছে এবার বোধ হয় এ আপত্তি, এই হতাশা কিছুটা লঘু হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কারণ বিজ্ঞানীরা ‘ডারপা’ নামের এমন এক কংক্রিট হাজির করেছেন, যা কিনা সপ্রাণ।

শুনে চমক লাগল? লাগারই কথা। ইট বা কংক্রিট, তা আবার জীবন্ত! হ্যাঁ, একদম তাই। বিষয়টি অনেকটা সেই মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইনের মতো শুনতে হলেও তা আশাবাদী করছে। বিজ্ঞানীরা ফটোসিনথেটিক অণুজীব ব্যবহার করে এক ধরনের কংক্রিট বানিয়েছেন, যা সপ্রাণ।

শত শত বছর ধরে কোনো ভবন বা কাঠামো তৈরিতে ইট, সিমেন্ট, বালিসহ নানা ধরনের উপাদানের মিশ্রণে তৈরি কংক্রিট ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ধরন ও মানে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মোটাদাগে চারপাশে যেসব অবকাঠামো দেখা যায়, তার নির্মাণে এ পদ্ধতিটিই ব্যবহার করা হয়। এই কংক্রিট তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবটি অনেক দিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। আর এর নিষ্প্রাণ প্রকরণ নিয়ে হতাশার বিষয়টি তো আগেই বলা হয়েছে। এ অবস্থায় একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্পের খোঁজে অনেক দিন থেকেই ছিলেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে তাঁরা এমন এক বিকল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন, যা শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, জীবন্ত সত্তাও।

কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল বিজ্ঞানী সম্প্রতি এমন এক ধরনের কংক্রিট তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন, যা শুধু জীবন্তই নয়, পুনরুৎপাদনেও সক্ষম। বিভিন্ন ক্ষেত্রের এক দল বিজ্ঞানীর সম্মিলিত চেষ্টায় এ কংক্রিট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। নতুন এই বস্তুতে বিভিন্ন খনিজকে একীভূত করার কাজটি করা হয়েছে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার সহায়তায়। এই ব্যাকটেরিয়া তার শক্তি আহরণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়। ফলে এটি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। আর তাই এই কংক্রিট বিদ্যমান কংক্রিট উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলোর একেবারে বিপরীত।

গবেষণার তহবিলদাতা প্রতিষ্ঠানের নামে নামকরণ করা ‘ডারপা’ নামের সবুজ বর্ণের এ কংক্রিট নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপ্রেমী নাগরিকদের সবুজের আশ মেটাবে। আর যেহেতু এটি একটি জীবন্ত সত্তা, তাই এটি প্রতারণাও নয়। এ বিষয়ে গবেষক দলের প্রধান ও কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার উইল সারবার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, সবুজ রঙের এই কংক্রিট সত্যিই ফ্রাংকেনস্টাইনের কথাই মনে করিয়ে দেবে, যদিও তা আশাই জাগায়।

গবেষক দলে থাকা অন্য বিজ্ঞানীরা মূলত এই কংক্রিটটির জীববৈজ্ঞানিক দিকটি নিয়ে কাজ করেছেন। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এই কংক্রিট নিজের ক্ষয় নিজেই সারিয়ে তুলতে পারবে। এটি একটি বিরাট অগ্রগতি। কারণ, এর মাধ্যমে কোনো একটি অবকাঠামোর সংস্কার ব্যয় ব্যাপকভাবে কমে আসবে।

এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি ‘ম্যাটার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই নিবন্ধে বলা হয়, একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও পুনরুৎপাদনে সক্ষম এই নির্মাণ সামগ্রী ভবিষ্যতের পথে এক বড় পদক্ষেপ।

গবেষণা নিবন্ধে জানানো হয়, জীবন্ত এই কংক্রিট তৈরিতে গবেষকেরা প্রথমে গরম পানি, বালি ও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি একটি মিশ্রণে সায়ানোব্যাকটেরিয়া যুক্ত করেন। অণুজীবটি তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকেই সূর্যালোক শোষণের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট উৎপাদন করে, যা মিশ্রণে উপস্থিত বালির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একে ক্রমে কংক্রিটে পরিণত করে।

এই বিশেষ নির্মাণ সামগ্রী তৈরি নিঃসন্দেহে একটি সুখবর। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এটি তৈরি হতে বেশ সময় লাগে। গবেষণার তহবিলদাতা প্রতিষ্ঠান মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি (ডারপা) চায় এমন একটি নির্মাণ সামগ্রী হাতে পেতে, যা জীবন্ত এবং খুব দ্রুত পুনরুৎপাদনে সক্ষম। গবেষকেরা এখন সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন। এরই মধ্যে এ পথে অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে। গবেষকেরা এই মিশ্রণে যুক্ত করেছেন জেলাটিন, যা পুরো প্রক্রিয়াকে দ্রুত গতির করার পাশাপাশি কংক্রিটের শক্তিও বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে নতুন এ নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করেও দেখেছে গবেষক দল, যা পরীক্ষা করে সন্তোষজনক বলে মত ব্যক্ত করেছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞেরা।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এতে ব্যবহৃত বালি প্রাকৃতিক উৎসেরই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিদ্যমান অবকাঠামোর ভাঙা অংশ, কাচ ইত্যাদি থেকেও ‘ডারপা’ নামের এই কংক্রিট তৈরি করা যাবে। পূর্ণ শক্তিতে পৌঁছাতে এর এক-দু দিন সময় লাগে। সাধারণ তাপমাত্রায় এর মধ্যে থাকা অণুজীব নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকবে, যাকে প্রয়োজনে সক্রিয় করা যাবে। সব মিলিয়ে নগরায়ণের এ যুগে এই নতুন নির্মাণ সামগ্রী কিছুটা হলেও প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা কাটাবে। আর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বদলে শোষণের কারণে পরিবেশবান্ধব হওয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই।