করোনাবশের চেষ্টায় জাপানের গবেষকেরা

বিশ্ব এখন নতুন এক সংকটের মুখে। এই সংকটের কারণ যে অদৃশ্য শত্রু, তার থাবা থেকে এখন কেউ মুক্ত না। কিন্তু এর মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি বলা যায় ছিল শূন্যের ঘরে।

যুদ্ধের সূচনা চীনে হওয়ার মুখে দূরের কিছু দেশ ‘তোমার সমস্যা আমার নয়’ বলে দূরে সরে ছিল, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করার জন্য চীনকে দায়ী করে চলেছিল। তারাও অচিরেই বুঝতে পেরেছে যে অদৃশ্য শত্রুর এই আঘাত একক কোনো দেশকে লক্ষ্য ধরে নয়, বরং লক্ষ্য হচ্ছে মানবজাতি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়া অবস্থায় এটা আমরা এখন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি। ফলে এই যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করে নিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে বিশ্বজুড়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুকে প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই।

করোনাভাইরাস অন্যদিক থেকে সংঘাতময় এই বিশ্বের জন্য নতুন যে বার্তা নিয়ে এসেছে তা হলো, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য একে অন্যের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে নেমে নিজের শক্তির অপচয় না করে বরং হাতে হাত মিলিয়ে অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে না পারলে কেউই আমরা বিপদের বাইরে থাকতে পারব না। চরম সংকটকালে এ রকম অভূতপূর্ব মেলবন্ধনের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করতে শুরু করেছি।

ফলে এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গোটা বিশ্ব মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ। শত্রুকে পরাভূত করার লড়াই যে কয়েকটি ফ্রন্টে যুগপৎ এগিয়ে চলেছে, তার সর্বাগ্রে আছেন সারা বিশ্বের চিকিৎসক সমাজ। এ রকম প্রমাণ রাখার সময় এখন তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়েছে যে শুধু অর্থ উপার্জনের জন্যই নয়, বরং সর্বাগ্রে মানবতার সেবা করার জন্য এই পেশা তাঁরা বেছে নিয়েছেন। আর মানবতার সেবা করতে গিয়ে তাঁদের নিজেদের জীবনও যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেটাও আমরা লক্ষ করছি। তবে ঝুঁকি সত্ত্বেও পেশাগত দায়িত্ব তাঁরা এবং সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যকর্মীরা যে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, সে জন্য প্রশংসা তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য।

চিকিৎসকদের পাশাপাশি অন্য যে আরেক দল যোদ্ধা চোখের আড়ালে থেকে মানবজাতিকে এই সংকট থেকে মুক্ত করার চেষ্টা নিরলসভাবে চালয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা হলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকেরা। নতুন ওষুধ আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে শত্রুকে পরাভূত করার সংগ্রামে তাঁরা নিয়োজিত। এই দলে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের গবেষকেরা আছেন। এই সময়ে অনেকটা রকেটের গতিতে তাঁরা ছুটে চলেছেন লক্ষ্য অর্জনের জন্য। এঁদের সেই অবদান আর ত্যাগের কথা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। যদিও করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ায় এ পর্যন্ত অর্জিত সাফল্য তাঁদের একেবারে কম নয়।

ভাইরাস বা চোখে না দেখা জীবাণু আমাদের চারপাশে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই। তবে এসব জীবাণু বিশেষ কোনো কারণে পাগলাটে হয়ে উঠে নিজেদের রূপান্তর ঘটিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করলে বিপত্তি তখনই দেখা দেয়। কী কারণে জীবাণুর পাগলাটে হয়ে ওঠা, সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই প্রবণতার সূচনা মনে হয় তখন থেকে, মানুষ যখন নিজের শত্রুকে বধ করার বাসনা থেকে অস্ত্র হিসেবে জীবাণু কাজে লাগানোর মতো ভয়ংকর তৎপরতায় জড়িত হতে শুরু করে। জীবাণু অস্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এবং এর ঠিক পরপরই পাগলাটে হয়ে ওঠা জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে বধ করতে শুরু করে। স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত সেই সময়ের মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছিল ৫ কোটি মানুষ। এবারেও যে পাগলাটে করোনা ফ্লুর দাপটের পেছনে সে রকম কোনো কারণ নেই, তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কেননা নানা রকম আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও আইনকানুন সত্ত্বেও বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো আড়াল-আবডালে জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে পিছিয়ে নেই।

তবে উল্টোভাবে আবার আশা জাগানিয়া দিকটি হলো এ রকম যে, জীবাণু বশ মানানোর গবেষণাও বিশ্বজুড়ে তীব্রগতিতে এগোচ্ছে। সেই দায়িত্বে নিয়োজিত গবেষকেরাই এখন নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন করোনাভাইরাস বধের উপায় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায়। তাঁদের সেই দৌড় সময়ের বিরুদ্ধে শোনালেও সাফল্য অর্জন থেকে খুব বেশি দূরে তাঁরা নেই। জাপানের সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সেই বার্তা আমাদের দিচ্ছে।

করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ওষুধের প্রয়োগগত সাফল্যের প্রথম খবরটি এসেছিল চীন থেকে। চীনে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় জাপানের ফুজি ফিল্ম হোল্ডিং গ্রুপের একটি কোম্পানির আবিষ্কার এভিগানের ব্যবহার অনেক রোগীকে রোগমুক্ত হতে সাহায্য করে। ফলে চীনে এখন করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এভিগানের প্রয়োগ অব্যাহত আছে। এভিগান তৈরিই হয়েছিল সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এর ব্যবহারিক সাফল্য অনেকটা কাকতালীয় মনে করছে ওষুধের উদ্ভাবক কোম্পানি। তবে এর রাসায়নিক উপাদানে কিছুটা রদবদল করে এটাকে করোনাভাইরাস চিকিৎসার উপযোগী করে তোলার জন্য কোম্পানির গবেষকেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে ১৯ জন রোগীর ওপর এর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষা সফল প্রমাণিত হলে জাপান সরকার এর ব্যবহারের অনুমতি দেবে। সে ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাপান নিশ্চিতভাবে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

জাপান সরকার অবশ্য ইনফ্লুয়েঞ্জার মোকাবিলার জন্য এভিগান মজুত করে রেখেছে। সরকারের বর্তমান মজুত দিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৭ লাখ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। জাপান সরকার বলছে, অন্য কোনো দেশ করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহার করার জন্য এভিগান পাওয়ার অনুরোধ জানালে তারা বিনা মূল্যে তা সরবরাহ করবে। জাপানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, করোনা বিস্তারের মুখে সরকার এভিগানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে নির্দেশ দিয়েছে। ফুজি ফিল্মও চাহিদা পূরণ করতে আউটসোর্সিংয়ে করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছে।

ফুজি ফিল্মের পাশাপাশি দেশের অন্য কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং দেশের নেতৃস্থানীয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরাও করোনার ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছেন। পাশাপাশি প্রচলিত আরও কয়েকটি ওষুধের কার্যকারিতাও যাচাই করে দেখা হচ্ছে। সে রকম একটি ওষুধ হচ্ছে তেইজিন ফার্মা লিমিটেডের সাইক্লোসোনাইড, আলভেসকো নামে যেটা বাজারজাত করা হয়। হাঁপানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই স্টেরয়েড ইনহেলার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কয়েকজন রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে এর সুফল সম্পর্কে জানতে পেরেছেন গবেষকেরা। ফলে এটাও করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য আরও বেশি কার্যকর করে তোলার গবেষণা অব্যাহত আছে।

জাপানের জাতীয় বিশ্ব স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কেন্দ্র গত মাসে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের ওষুধ আবিষ্কারের আন্তর্জাতিক উদ্যোগে তারা যোগ দিচ্ছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আরোগ্যের জন্য শুধু ওষুধ নয়, প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে সে রকম টিকা হাতে এসে যাওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী। তবে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কেন ইশির মতে, ‘যত দ্রুতই আমরা টিকা আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যাই না কেন, কম করে হলেও এক বছর সময় লেগে যাবে।’

করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা ভেন্টিলেটর এবং হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ করা ইসিএমও যন্ত্রের উৎপাদন বাড়াতে ব্যবস্থা নিচ্ছে জাপান। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিতে যন্ত্রের ঘাটতি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা জাপানকে উদ্বিগ্ন করেছে। তবে এসব যন্ত্র বেশ ব্যয়বহুল। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৩ এপ্রিল সংসদের উচ্চকক্ষের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগীর মধ্যে ৬২ জনের ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেলে ব্যবহারের জন্য ৮ হাজারের বেশি ভেন্টিলেটর সরকারের কাছে আছে। অন্যদিকে ইসিএমও যন্ত্র সারা জাপানে হাসপাতালগুলোতে আছে মাত্র ১ হাজার ৪০০টি। সে জন্য উভয় যন্ত্রের উৎপাদন বাড়াতে সরকার এখন আগ্রহী।

এই ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো, এসব যন্ত্র সঠিকভাবে চালানোর মতো পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষজ্ঞ জাপান কিংবা অন্যান্য দেশে আছে কি না। জাপানের জাতীয় বিশ্ব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত বিশেষজ্ঞ নোরিও ওমাগারি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যন্ত্র তো হচ্ছে কেবল যন্ত্র, চিকিৎসায় নিয়োজিত একটি দলকে, যা একত্র করে তা হলো মানুষ। ফলে যন্ত্র চালানোর মতো দক্ষ মানবসম্পদ নিশ্চিত করতে পারার বিষয়টি অবহেলা করা উচিত নয়।’