জামা-কাপড়-জুতা-চুলে কি করোনাভাইরাস আটকায়?

আপনি সহজে বাইরে যান না। ঘরেই থাকেন। কিন্তু সেদিন জরুরি কিছু ওষুধ কেনার জন্য পাড়ার দোকানে গেছেন। অন্য কারও থেকে অন্তত দুই হাত দূরে থেকেছেন। বাসায় ফিরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়েছেন। মুখের মাস্কটা এক মগ সাবান পানিতে ভিজিয়ে রেখেছেন। ভাবছেন আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি যে, আপনার জামা-কাপড়, চুল, জুতায় করোনাভাইরাস লেগে আছে কি না?

আমরা জানি দু-চার ফুট দূরে থেকে কেউ যদি কথা বলেন, তাহলে ভাইরাস আপনার গায়ে লাগবে না। অবশ্য যদি জোরে হাঁচি-কাশি দেয় তাহলে ছয় ফুট দূরে থাকলে নিরাপদ। এ সবই ঠিক। কিন্তু কিছু ক্ষত্রে ব্যতিক্রমও থাকে। জুতা তো অবশ্যই। পিচ ঢালা রাস্তায় কোনো করোনা রোগী থুতু ফেললে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা সেটা থাকবে এবং আপনারা জুতার নিচে লেগে বাসা পর্যন্ত যাবে। সে জন্য জুতা জোড়া বাইরে খুলে আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকবেন। ঘরের ভেতরে যে স্যান্ডেল পরবেন, সেটা কখনো বাইরে নেবেন না। এ কথাগুলো আমরা এখন সবাই জানি। কিন্তু, জামা-কাপড়, চুল?

এ বিষয়গুলো নিয়ে দা নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সপ্তাহ খানিক আগে ( ১৭ এপ্রিল, আপডেট ১৮ এপ্রিল ২০২০) লিখেছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে কিছু জরুরি পরামর্শ ওরা দিয়েছে। কাপড়ের ব্যাপারটাই ধরুন না। ঘরে ফিরেই কি জামা-কাপড় ধুয়ে ফেলতে হবে, গোসল করতে হবে? গবেষণায় দেখা গেছে, না, সব সময় এত কিছুর দরকার নেই। এটা বোঝার জন্য আমাদের জানতে হবে বায়ু প্রবাহের গতি-প্রকৃতির (অ্যারো-ডায়নামিকস) কয়েকটি সাধারণ নিয়ম। আমরা জানি, কথা বলা বা হাঁচি-কাশির সময় অতি ক্ষুদ্র পানির কণার (ড্রপলেট) সঙ্গে ভাইরাসটি কিছু দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু একটু জোরে কথা বললে বা হাঁচি-কাশি দিলে সেটা বাতাসে বেশ কিছু দূর ভেসে চলতে থাকে। এই সময় আমরা ওই এলাকা দিয়ে হেঁটে গেলে ড্রপলেটগুলো সাধারণত আমাদের পাশ কাটিয়ে বাতাসে ভেসে যাবে, জামা-কাপড়ে লাগবে না।

কেন ভাইরাস কাপড়ে লাগবে না?

ভার্জিনিয়া টেক-এর অ্যারোসল বিজ্ঞানী লিনজি মার (Linsey Marr) ব্যাখ্যা করে বলেন, আমরা সাধারণত আস্তে হাঁটি। চলার গতির কারণে সামনের বাতাস একটু ধাক্কা খেয়ে ড্রপলেটগুলোসহ আমাদের দুপাশ দিয়ে চলে যাবে। এ কারণে বাতাসে ভাসমান ড্রপলেটগুলো আমাদের জামা-কাপড়ে সাধারণত লাগবে না। যেমন, আমরা দেখি, কোনো গাড়ি যদি ধীরে চলে তাহলে তার সামনের কাচে ধুলাবালু কম লাগে। কিন্তু জোরে চললে বেশি লাগে। আমাদের হেঁটে চলার ক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটে। তবে যদি কেউ খুব সামনাসামনি এসে থুতু ছিটিয়ে কথা বলেন, বা খুব জোরে হাঁচি-কাশি দেন, তাহলে অবশ্যই বাসায় ফিরে কাপড় ধুয়ে নিতে হবে। কিন্তু সে রকম কিছু না হলে, রাস্তা দিয়ে ধীরে হেঁটে যাওয়ার সময় পদার্থ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মেই ভাইরাসবাহিত ক্ষুদ্র বাতাসের কণাগুলো দু পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, জামা কাপড়ে লাগবে না। ড্রপলেটগুলো খুব ভারী হলে সমস্যা হতো, কিন্তু ড্রপলেটগুলো এত ক্ষুদ্রাকায় যে গায়ে লাগার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তাই বাইরে ব্যবহৃত কাপড় খুলে বারান্দায় কয়েক ঘণ্টা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলেও চলে। ঘরে ঢুকে অন্য কাপড় ব্যবহার করা যায়।

তবে বিজ্ঞানীরা বারবার সাবধান করে বলেন, এ সব ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। চলার পথে খেয়াল রাখতে হবে, কখন কম ঘটছে, আশপাশ দিয়ে কে কীভাবে যাচ্ছেন ইত্যাদি। সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।

চুলের ঝুঁকি কতটা?

আমরা সাধারণত চুলের ব্যাপারটা চিন্তা করি না। জামা কাপড়ে ভাইরাস লেগে যাওয়ার ভয় যেমন সাধারণভাবে কম, চুলের ক্ষেত্রেও দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন সেন্ট লুই চিলড্রেনস হসপিটালের শিশু সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্ড্রু জানোওয়াস্কি (Dr. Andrew Janowski) বলেন, ধরা যাক, কেউ একজন আপনার পেছন থেকে জোরে হাঁচি দিল। বেশ কিছু ভাইরাস চুলে লেগে গেল। তাহলে তো নিশ্চয়ই আপনি ঝুঁকিতে পড়লেন। কিন্তু কতটা ঝুঁকি? আপনাকে পেছনে চুলে হাত দিতে হবে। তার পর সেই হাত নাকে-চোখে স্পর্শ করলে আপনি ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন। এটা একটা বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ঝুঁকি যে নেই, তা নয়। তবে খুব কম। অবশ্য সে রকম ভয় থাকলে ঘরে ফিরে গোসল করে নেওয়াই ভালো।

ভিটামিন-ডি

করোনার এই ভয়ের সময় ভিটামিন-ডি খুব দরকার। এটা ক্যালসিয়াম, ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ পদার্থ শরীরে সংশ্লেষণে সাহায্য করে। আমাদের দাঁত ও হাড় শক্ত করে। তবে এই সময়ে ভিটামিন-ডি এর বেশি প্রয়োজন। কারণ এটা পেশি, স্নায়ু ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সূর্যের আলো থেকে এই ভিটামিন পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডিম, চর্বিসমৃদ্ধ মাছ, দুধ ও খাদ্যশস্য থেকে ভিটামিন-ডি পাওয়া যায়। এই ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে দরকার।

নিয়মিত ব্যায়াম

এই সময় লকডাউনে বাসায় বিশেষ কিছু ব্যায়াম করা দরকার। এদের মধ্যে ব্রিদিং ও স্ট্রেচিং তো অবশ্যই করতে হবে। সকাল ও সন্ধ্যায় প্রতিদিন মাত্র পাঁচ মিনিট করে দুবার ব্যায়াম করুন। বুক ভরে শ্বাস নিন। কয়েক সেকেন্ড ধরে রেখে মুখ দিয়ে এক ঝটকায় ছাড়ুন। এ রকম করুন কয়েকবার। আর স্ট্রেচিং এর জন্য হাত ও পায়ের সব অস্থিসন্ধিগুলো হালকাভাবে নাড়াচাড়া, হাত দিয়ে পা ছোঁয়া, চোখ দুটো কয়েকবার হালকাভাবে ঘোরানো ইত্যাদি। ব্রিদিং ও স্ট্রেচিং বিভিন্নভাবে করা যায়, আজকাল এর সচিত্র বিবরণের জন্য গুগল করুন।

খুব হালকা ব্যায়াম। কিন্তু আপনাকে সব সময় সতেজ রাখে।

আব্দুল কাইয়ুম: মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
ই মেল: [email protected]