উইকিপিডিয়ানদের মহামিলন

মুক্ত বিশ্বকোষ রচনায় স্বেচ্ছায় কাজ করেন তাঁরা। প্রতিবছর বসে তাঁদের মহাসম্মেলন—উইকিম্যানিয়া। এবার এ আয়োজন হয়েছে হংকংয়ে
মুক্ত বিশ্বকোষ রচনায় স্বেচ্ছায় কাজ করেন তাঁরা। প্রতিবছর বসে তাঁদের মহাসম্মেলন—উইকিম্যানিয়া। এবার এ আয়োজন হয়েছে হংকংয়ে

উইকিপিডিয়া বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ। ইন্টারনেটভিত্তিক এই বিশ্বকোষ তৈরির জন্য কাজ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা উইকিপিডিয়ান নামে পরিচিত।  বর্তমানে ২৮৭টি ভাষায় উইকিপিডিয়া রয়েছে।উইকিপিডিয়া একটি মুক্ত জায়গা, যেখানে সবাই অংশ নিতে পারে এবং এটি সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখতে পারে। সামগ্রিকভাবে উইকিপিডিয়া ও এর সহপ্রকল্পগুলো পরিচালনার কাজটি করে থাকে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ভাষার উইকি প্রকল্পগুলোর উইকিপিডিয়ানদের নিয়ে বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ‘উইকিম্যানিয়া’ আয়োজন করে আসছে।

এবারের উইকিম্যানিয়া
হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে ২০১৩ সালের উইকিম্যানিয়া আয়োজনের দায়িত্বে ছিল উইকিমিডিয়া হংকং। ৯ থেকে ১১ আগস্টের এই অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয় ১০০টিও বেশি উপস্থাপনার। এ ছাড়া মূল অনুষ্ঠানের আগের দুই দিনেও আয়োজন করা হয়েছিল একাধিক সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান ও কর্মশালার। এবারের উইকিম্যানিয়ায় ৯০টি দেশ থেকে এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে আমরা চারজন অংশ নিই। বাকি দুজন হলেন আলী হায়দার খান, বেলায়েত হোসেন ও তানভির রহমান।

মূল সম্মেলনের আগের দিন হংকংয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতার (প্রায় এক হাজার ৩০০ ফুট) ৩৬০ ডিগ্রি অবজারভেশন টাওয়ার স্কাই ১০০ বা ইন্টারন্যাশনাল কমার্স সেন্টারে স্বাগত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ৯ আগস্ট সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহী ড্রাগন নাচের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন হংকং সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ডেনিয়াল লাই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাকোটো ওকামোটো। আর এর পরে উইকিপিডিয়ার বর্তমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন উইপিডিয়ার সহপ্রতিষ্ঠাতা জিমিওয়েলস।

যা যা ছিল

সম্মেলনের আয়োজনগুলো একই সঙ্গে সাতটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন উইকিপিডিয়া ও এর অন্য সহপ্রকল্পগুলোর প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। পাশাপাশি উইকিমিডিয়ার কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করা এবং আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে চ্যাপ্টার বা স্থানীয় কমিউনিটি রয়েছে। এসব স্থানীয় কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গুলো প্রদর্শন করা হয় অনুষ্ঠানের প্রথম দিন। চীনে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ, তাইওয়ানে উইকিপিডিয়া প্রসারের উদ্যোগ ও উইকিপিডিয়ার শুরু থেকে হংকংয়ে এর বিস্তার নিয়ে আলাদা আলাদা উপস্থাপনা ছিল। গ্যালারি, লাইব্রেরি আর্কাইভ ও জাদুঘরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে উইকিপিডিয়ার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জিএলএএম নামের একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। সম্মেলনের তিন দিনই এই বিষয়ে একাধিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। কীভাবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু করতে হয়, কাজ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শ ও সাধারণভাবে কী কী বাধার সম্মুখীন হতে পারে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এই সেশনগুলোয়।

উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন ভাষায় লেখার পদ্ধতি, ব্যাকরণ, ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আলাদা। কিন্তু এসব ভাষার উইকিপিডিয়াই মিডিয়াউইকি নামের একটি মাত্র সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। আবার উইকিমিডিয়া কমন্স নামের প্রকল্পটি কেন্দ্রীয়ভাবে সব ভাষার উইকিপিডিয়া ও এর সহপ্রকল্পগুলোর সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভাষার বৈচিত্র্যগুলো কীভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে এবং সমাধান করা হয়নি—এমন ত্রুটি নিয়েও আলোচনা করা হয় এই সম্মেলনের একাধিক সেশনে।

বিভিন্ন ভাষার উইকিপিডিয়া ব্যবহারকারী এবং এগুলোয় অবদান রাখছেন—এমন সবার জন্য উইকিপিডিয়ায় বেশ কিছু নতুন সফটওয়্যার বা টুল যোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু টুল তৈরির কাজ চলছে। উইকিপিডিয়ায় নতুন ব্যবহারকারীরা যেন সহজে এখানে অবদান রাখতে পারেন, সেই লক্ষ্যে উইকিপিডিয়াতে ভিজ্যুয়াল এডিটর নামের বিশেষ একটি সম্পাদনা টুল যোগ করা হচ্ছে।

উইকিপিডিয়ায় সাম্প্রতিক সংযোজিত ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ সিলেক্টর ও জেকিয়েরি আইএমই এক্সটেনশনগুলো নিয়েও আলাদা আলাদা অধিবেশনে আলোচনা করা হয় এবং একই সঙ্গে উইকিপিডিয়ায় ব্যবহূত সফটওয়্যারগুলো তৈরির সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যায় এবং অবদান রাখা যায়, সে বিষয়গুলো হাতেকলমে দেখিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মূল সম্মেলনের আগে দুই দিন ডেভ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছিল।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  ও শিক্ষামূলক কাজে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশে উইকিপিডিয়া বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাক্ষেত্রে উইকিপিডিয়া ব্যবহারের সুবিধা, উইকিপিডিয়া জিরো প্রকল্প ও উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রামগুলো নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল মূল অনুষ্ঠানের আগের দুই দিন এবং অনুষ্ঠানের প্রথম দিন। এই সেশনগুলোতে বর্তমানে চালু রয়েছে এমন বিভিন্ন প্রকল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি টুলগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে উইকিপিডিয়া বিস্তারের ক্ষেত্রে আফ্রিকা ও এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলের ব্যবহারকারীরা উইকিপিডিয়ায় বেশি অবদান রাখছেন এবং সাধারণ ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেশি এই এলাকাগুলোয়।

এই সম্মেলনের বিভিন্ন দিনে এশিয়া ও অন্য দেশগুলো থেকে আসা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে উইকিমিডিয়া বাংলদেশ। উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ হলো বাংলাদেশে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের অনুমোদিত চ্যাপ্টার। সাংগঠনিকভাবে পরস্পরকে সহায়তা করা, নিজেদের সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে এগুলোর বিস্তার লাভ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজে উইকিপিডিয়া ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয় এ সময়।

বাংলাদেশে উইকিপিডিয়ার কার্যক্রম বিস্তারের ক্ষেত্রে কাজ শুরু করেছে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের মেইল তালিকায় (https://lists.wikimedia.org/mailman/listinfo/wikimedia-bd) যোগ দিয়ে বাংলাদেশের উইকিপিডিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেওয়া যাবে।

লেখক: প্রশাসক, বাংলা উইকিপিডিয়া