কালে কালে মোটরসাইকেল

পৃথিবীর প্রথম মোটরসাইকেলছবি: সংগৃহীত

মোটরসাইকেল আধুনিক বিশ্বে গতি ও প্রকৌশলী সক্ষমতার অনন্য এক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। দুই চাকার এই যানের বিবর্তনের ইতিহাস কয়েক শ বছরের।

মোটরসাইকেলের ধারণার সঙ্গে সাইকেলের ইতিহাসের বিকাশ দেখা যায়। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মাধ্যমে দ্বিচক্রযান তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা দেখা যায় ১৮৬০ দশকে। ১৮৬৭ সালে আমেরিকান উদ্ভাবক সিলভেস্টার হাওয়ার্ড রোপার একটি বাষ্পচালিত সাইকেল তৈরি করেন। প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি টুইন সিলিন্ডার স্টিম ভেলোসিপেড তৈরি করেন। আধুনিক মোটরসাইকেলের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত এই যানের দুই চাকার মাঝখানে কয়লার আগুনের বয়লার ছিল। ছোট স্টিম ইঞ্জিন ফ্রেমের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।

হোন্ডা উৎপাদিত প্রথম মোটরসাইকেল
ছবি: সংগৃহীত

১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের লুই-গিলোমে পেরেঅক্স একটি আবিষ্কারস্বত্বের জন্য আবেদন করেন। পিয়েরে মিশক্স লুইস ও গিলোমে পেরেঅক্স যুক্ত হয়ে স্টিম ভেলোসিপেড তৈরি করেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে এটিই প্রথম প্রকৃত মোটরসাইকেল। পিয়েরে মিশক্স লুইসের বাইসাইকেলে লুই-গিলোমে পেরেঅক্স একক সিলিন্ডার স্টিম ইঞ্জিন যুক্ত করেছিলেন। ১৮৭১ সালের পর এই যান দেখা যায় বলে জানা যায়।

১৮৮৫ সাল মোটরসাইকেলের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী বছর। জার্মান উদ্ভাবক গটলিব ডাইমলার ও উইলহেম মেবাখ মিলে ডাইমলার রেইটওয়াগেন তৈরি করেন, যার ইংরেজি অর্থ রাইডিং কার। এটি ছিল পেট্রোলিয়ামচালিত অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনচালিত প্রথম দুই চাকার যান। যদিও এর চারটি চাকা ছিল। দুটি প্রধান চাকা ও দুটি ছোট স্ট্যাবিলাইজার চাকা। এটিই ছিল প্রথম সত্যিকারের গ্যাসোলিনচালিত মোটরযুক্ত দ্বিচক্রযান। এই যান আধুনিক মোটরসাইকেলের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। এটিই প্রথম মোটরসাইকেল হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এই আবিষ্কারের জন্য ডাইমলারকে প্রায়ই মোটরসাইকেলের জনক বলা হয়।

১৮৯৪ সালে হিল্ডেব্র্যান্ড অ্যান্ড উলফমুলার প্রথম মোটরসাইকেলের সিরিজ উৎপাদন শুরু করে। তাদের নির্মিত যন্ত্রকেই প্রথম মোটরসাইকেল বা জার্মান ভাষায় মোটরর‍্যাড বলা হয়। মোটরসাইকেল মাত্র কয়েক শ তৈরি করা হয়েছিল। মোটরসাইকেল শব্দটি একই বছর ইংরেজি ভাষায় ইজে পেনিংটনের মেশিনে ব্যবহার করা হয়।

ফ্রান্সে তৈরি প্রথম দিককার মোটরসাইকেল
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্য এক্সেলসিয়র মোটর কোম্পানি ১৮৯৬ সালে তাদের প্রথম মোটরসাইকেল মডেল উৎপাদন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মোটরসাইকেল উৎপাদন করে ওরিয়েন্ট-অ্যাস্টার। ১৮৯৮ সালে চার্লস মেটজ ম্যাসাচুসেটসের ওয়ালথামে তাঁর কারখানায় এই মোটরসাইকেল তৈরি করেছিলেন।

বিশ শতকের শুরুতে মোটরসাইকেল একটি জনপ্রিয় যানে পরিণত হয়। অনেক কোম্পানি এটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। ১৯০১ সালে ব্রিটেনের রয়্যাল এনফিল্ড প্রথম মোটরসাইকেল তৈরি করে। একই বছর, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান মোটোসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি প্রথম রেসিং মোটরসাইকেল তৈরি করে। ১৯০৩ সালে হার্লে-ডেভিডসন প্রথম প্রোডাকশন মডেল মোটরসাইকেল তৈরি করে। এ সময় অসংখ্য ছোট-বড় কোম্পানি মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন মোটরসাইকেল সামরিক যোগাযোগের জন্য ও সৈন্যদের দ্রুত চলাচলের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। হার্লে-ডেভিডসন ও ইন্ডিয়ান মোটোসাইকেল মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য বিপুলসংখ্যক বাইক সরবরাহ করে। ১৯২০-১৯৩০ দশকে মোটরসাইকেলের নকশায় পরিবর্তন দেখা যায়। সাসপেনশন, ব্রেক ও গিয়ারবক্সের মতো উপাদান উন্নত হয়। বিভিন্ন রেসিং আয়োজন শুরু হয় এ সময়। ১৯৩০ দশকে যুক্তরাজ্যে নর্টন, ট্রায়াম্ফ ও এজিএসের মতো কোম্পানির ৮০ রকমের মোটরসাইকেলের প্রচলন দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলাকালে মোটরসাইকেলের ব্যবহার দেখা যায়। বিএমডব্লিউ আর৭৫ ও হার্লি-ডেভিডসনের মডেল ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

জার্মানিতে তৈরি প্রথম দিককার মোটরসাইকেল
ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মোটরসাইকেলশিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। জাপানি কোম্পানি মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। ১৯৫০–এর দশকে ব্রিটিশ মোটরসাইকেল নর্টন, বিএসএ ও ট্রায়াম্ফ বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাপানি নির্মাতাদের মধ্যে হোন্ডা ছোট ও নির্ভরযোগ্য মডেলের জন্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১৯৫১ সালে বিএসএ গ্রুপ ট্রায়াম্ফ মোটরসাইকেল অধিগ্রহণ করে। জার্মান নির্মাতা এনএসইউ ১৯৫৫ সাল থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মোটরসাইকেল উৎপাদন করে। ১৯৫৯ সালে হোন্ডা বাজার দখল করে।

১৯৬০–এর দশকে জাপানি মোটরসাইকেল কোম্পানি হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি ও কাওয়াসাকি বিশ্ববাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে হোন্ডা সিবি৭৫০ ফোর মডেল বাজারে আনে। ১৯৬৯–২০০৮ সাল পর্যন্ত এই মোটরসাইকেলের মডেল বাজারে বিক্রি হয়। এতে ডিস্ক ব্রেক, ইলেকট্রিক স্টার্টার ও চার সিলিন্ডার ইঞ্জিনের জন্য জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ দশকে জাপানি নির্মাতারা পারফরম্যান্স বাইক, অফ-রোড বাইক (ডার্ট বাইক) ও ট্যুরিং বাইকের মতো বিভিন্ন সেগমেন্টে নিজেদের বাজার বড় করে।

হার্লে-ডেভিডসনের ১৯১৬ মডেলের ১০০০ সিসির বাইক
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০–এর দশক থেকে মোটরসাইকেলের নকশা, নিরাপত্তা ও পারফরম্যান্স আরও উন্নত হয়। ফুয়েল ইনজেকশন, অ্যান্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম, ট্র্যাকশন কন্ট্রোল ও অ্যাডভান্সড ইলেকট্রনিকস সিস্টেম বাইকে যুক্ত হতে শুরু করে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়। ইলেকট্রিক মোটরসাইকেলের বিকাশ ঘটে। হার্লে-ডেভিডসন প্রথম ইলেকট্রিক বাইক লাইভবায়ার বাজারে আনে। ২০০৬ সালে ডাচ্‌ কোম্পানি ইভিএ প্রোডাক্টস বিভি হল্যান্ড প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ডিজেলচালিত মোটরসাইকেল বাজারে আনে।