সাইবার অপরাধের ধরনে বদল, বেশি ঝুঁকিতে নারী ও শিশুরা

সিক্যাফের প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আলোচকেরা
ছবি: সংগৃহীত

নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে সাইবার অপরাধ। বুলিং কমলেও সাইবার অপরাধের বেশি শিকার নারী ও শিশুরা। বেড়েছে আর্থিক প্রতারণা। সাইবার জগতে শিশু ভুক্তভোগীদের হার ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচারের শিকার হয় শিশুরা।

বয়সভিত্তিক অপরাধের ধরনে ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা এ ধরনের অপরাধের শিকার সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ১২ শতাংশের ওপর। ২০১৮ সালে ৫টি জরিপে সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানানোর প্রবণতা কমেছে। ২০১৮ সালে ছিল ৬১ শতাংশ, যা নেমে হয়েছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সাইবার জগতে ভুক্তভোগীদের দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে আজ শনিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিক্যাফ) পঞ্চমবারের মতো এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশই অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অপর দিকে ভুক্তভোগীদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকড হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশই নারী।

অনুষ্ঠানে শুরুতেই বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিক্যাফের গবেষণা সহকারী স্বর্ণা সাহা। প্রতিবেদন উঠে এসেছে লিঙ্গভিত্তিক তুলনামূলক পরিসংখ্যানে পুরুষেরা সাইবার অপরাধের শিকার সবচেয়ে বেশি (৫৯ দশমিক ৭৩) হচ্ছেন। এর মধ্যে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিং-বিষয়ক অভিযোগ বেশি করেছেন পুরুষেরা (২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ)। ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ৫৫ শতাংশই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না। পাঁচ বছর ধরেই ভুক্তভোগীদের গড়ে প্রায় অর্ধেকই আইন সম্পর্কে অজ্ঞ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন, তার ফলাফল উদ্বেগজনক। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ভুক্তভোগীদের মধ্যে অভিযোগকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। জরিপে দেখা গেছে, আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার সাতটি কারণ রয়েছে। আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪ শতাংশ ভুক্তভোগীদের সিংহভাগই জানে না কীভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিষয়টি গোপন রাখতে ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়ত আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির ভয়ের কথা জানিয়েছেন ১৮ শতাংশ ভুক্তভোগী।

আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সন্তুষ্ট নন ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগী। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী যেসব ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশই অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় অসন্তুষ্ট। তবে ২০২২ সালের জরিপে আগের বছরের তুলনায় বেশ উন্নতি লক্ষ করা গেছে। অবশ্য সেই বছরের জরিপে ৩৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভুক্তভোগীই এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি। বিপরীতে এবারের জরিপে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয়ে মন্তব্য না করার হার ছিল ৪ দশমিক ৪৫।

প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা কর্মকর্তা নাহিয়ান রেজা সাবরিয়েত বলেন, সাইবার নিরাপত্তা বাড়াতে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন মাধ্যম ব্যবহার করে সাইবার জগতে অপরাধ বাড়ছে। গবেষণার মাধ্যমেই সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা-বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘নিজেদের নয়, আমরা অজানা জায়গা থেকে আসা প্রযুক্তি ব্যবহার করি। এ ছাড়া সাইবার জগৎ পুরোটাই ধোঁয়াশায় পূর্ণ। নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সলিউশনগুলো নিজেদেরই তৈরি করতে হবে।’ এ সময় ডিজিটাল ফরেনসিক তদন্তের জন্য সেগুলো নিরীক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের চেয়ে অপরাধীদের বিষয়ে প্রচারণায় আলোকপাতের দাবি জানান তিনি।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান বলেন, ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুলিশের সহায়তা না নেওয়াটার হারটা বিপজ্জনক। এর পেছনে রয়েছে ভুক্তভোগীদের প্রমাণ হাজিরের প্রক্রিয়াগত জটিলতা। এ জটিলতা দূর করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সাইবার জগতে যাপিত জীবনের বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে হবে বলে তিনি জানান। পাশাপাশি সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়ে তাগিদ দেন তিনি।

সম্মেলনে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যেই আইএসপিদের প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার এবং মোবাইল অপারেটরদের সাইবার ডিফেন্স নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছি। একই সঙ্গে শিগগিরই সাইবার সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষায়িত কল সেন্টার স্থাপন করতে যাচ্ছি। তবে এরই মধ্যে কিশোরদের সাইবার সচেতনতায় ১৩২১৯ কল সেন্টার করা হয়েছে। এভাবেই সবাই মিলে সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় কাজ করতে হবে।’

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, ‘যে কনটেন্ট আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না, তা দেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সাইবার অপরাধ দিন দিন খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের আগে থেকেই কাজ শুরু করতে হবে, নয়তো দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। ব্যান্ডউইডথ প্রবেশের সময়েই রাষ্ট্রের পক্ষেই এটি সুরক্ষিত কি না, তা নিশ্চিত করা দরকার।’