ফ্রিল্যান্সার শিল্পী, তানজিম ও আইরিন যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, সফল হয়েছেন

বিভিন্ন বাধা ডিঙিয়ে সফল হয়েছেন ফ্রিল্যান্সার শিল্পী, আইরিন ও তানজিমসংগৃহীত

ট্রেন দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছেন শিল্পী সেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার পরিবারে দারিদ্র্যের সঙ্গে বড় হতে হয়েছে তানিজম রহমানকে। একটা পুরোনো ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনতেও এক বছর সময় লেগেছে আইরিন আক্তারের। এই তিন নারীই বেড়ে উঠেছেন প্রতিকূলতার মধ্যে। তাঁদের মধ্যে বড় মিল হলো, বাধা ডিঙিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনজনই। এই তিন নারী এখন সফল ফ্রিল্যান্সার। ঢাকার বাইরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন কাজ করে প্রত্যেকেই মাসে হাজার ডলারের বেশি অর্থ আয় করছেন, হয়েছেন স্বাবলম্বী। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তিন ফ্রিল্যান্সার বাগেরহাটের শিল্পী সেন, মানিকগজ্ঞের তানজিম রহমান ও নেত্রকোনার আইরিন আক্তারের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তুলে ধরা হলো।

শিল্পী সেন
সংগৃহীত

ট্রেন দুর্ঘটনায় পা হারানো শিল্পী সেন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন

১৯৯৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার কানাইনগর গ্রামে জন্ম শিল্পী সেনের। বাবা বিকাশ সেন, জাহাজে চাকরি করতেন। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন শিল্পী। বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন। চার বছর বয়স থেকে সৎমায়ের অনাদর পেতে হয় শিল্পীকে। বাবার বাড়িও ছাড়তে হয় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়। অনাত্মীয় মানুষের বাড়িতে থেকে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে, ঘরের কাজ করে নিজের পড়ালেখা চালাতে হয়েছে শিল্পীকে।
শিল্পী সেন চেয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। জীবন যখন একটু গুছিয়ে এনেছেন, তখনই ঘটে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। তখন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউটের ছাত্রী শিল্পী। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনায় কাটা পড়ে তাঁর একটি পা। স্বপ্নভঙ্গ অবস্থা। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়েছেন শিল্পী। মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এখন সফল তিনি। মাসে আয় করেন দুই লাখ টাকার মতো।
২০১৬ সালের ৫ মার্চ ভোর সাড়ে চারটায় খুলনা থেকে মির্জাপুর স্টেশনে আসে সুন্দরবন এক্সপ্রেস। ট্রেন থেকে নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন শিল্পী সেন। ট্রেনের চাকার নিচে চলে যায় তাঁর পা। প্রাণপণ চেষ্টায় পরিচিত চিকিৎসক ও নার্সরা মিলে বাঁচিয়ে তোলেন তাঁকে। কিন্তু বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। সেই থেকে ক্রাচ আর কৃত্রিম পা শিল্পী সেনের সঙ্গী।

শিল্পী নিজে কিছু করতে চান, ঘরে বসে থাকতে চান না। তাই লেগে পড়েন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজে। নিজেকে দক্ষ করে তোলেন। প্রথম দফায় তেমন কাজ পান না। কিছুদিন বিরতি দিয়ে গত বছর আবার শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। দ্বিতীয় দফায় প্রচুর কাজ পেতে থাকেন শিল্পী। বিরতির পর প্রথম মাস থেকেই গড়ে দুই লাখ টাকার কাজ করেন তিনি। বাগেরহাটে বসে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে শিল্পী ফেসবুক অ্যাডস ও গুগল অ্যাডস ক্যাম্পেইনের কাজ করেন। বেশির ভাগ কাজ আসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন ও জার্মানি থেকে। শিল্পীর স্বপ্ন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার। তিনি বলেন, ‘অনেক প্রতিবন্ধী মানুষকে অবহেলিত হতে দেখেছি। খুব কষ্ট হয় আমার। তাই আমি নিজের পাশাপাশি সহযোদ্ধাদের পাশেও দাঁড়াতে চাই।’

শিল্পী সেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারী দিবসে সব নারীকে স্বাগত জানাই। আমরা যদি নারীদের সম্মান ও অধিকারের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিই , তাহলে আমাদের সমাজ আরও উন্নত হতে পারে। “পারব না” কথাটা আপনার জীবন থেকে মুছে দিন। আপনাকে যেকোনোভাবেই হোক পারতে হবে। আমি নারী হিসেবে সব নারীকে বলতে চাই, আমাদের সবার মধ্যেই প্রতিভা রয়েছে। যিনি সফল, তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছে, অন্যদের সুপ্ত অবস্থায় আছে। নিজের ভেতরে থাকা মূল্যবান সম্পদ খুঁজে বের করুন, নিজেকে স্বাবলম্বী করুন, স্বাধীনভাবে বাঁচুন, স্বপ্ন দেখুন এবং শিক্ষার মাধ্যমে নিজের প্রতিভাকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে যান।’

তানজিম রহমান
সংগৃহীত

অভাবের সংসারের হাল এখন তানজিমের হাতে

অভাবের সংসারে চার সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানো কষ্টের ছিল বাবার জন্য। তাই বাবা তাঁর মেয়ে তানজিম রহমানকে পরামর্শ দেন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের বদলে মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে। কিন্তু তানজিম চাইছিলেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে। তিনি ঠিক করেন পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় করবেন। তখন থেকেই উপার্জন করার কথা ভাবছেন তানজিম। তানজিম রহমান মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নের চানদুইর গ্রামে থাকেন। বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাহিনুর রহমান ও মা গৃহিণী শিল্পী বেগমের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তানজিম রহমান দ্বিতীয়।

তানজিম এখনো ছাত্রী। মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন। মানিকগঞ্জে বসেই তাঁর আয় প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা।
কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় চার-পাঁচজন ছাত্র পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেছেন তানজিম। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় চলে যেত পড়াতে। মাসে আয় করতেন পাঁচ হাজার টাকার মতো। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর চাকরির চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু পাননি।

স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে পরিবারে আর্থিক সহায়তা করার কথা ভাবেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? তানজিম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই সময়টা আমি ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। ফেসবুক ও ইউটিউবে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারি বিষয়টা সম্পর্কে।’ তানজিম সরকারের এলইডিপির একটা কোর্সে ভর্তি হন। ভর্তি হয়েও অবশ্য কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। কেননা, তাঁর নিজের কম্পিউটার ছিল না। বাবারও সামর্থ্য ছিল না কম্পিউটার কিনে দেওয়ার। তানজিম বলেন, ‘আমি বাবাকে অনেকবার বলি। কিন্তু মুদিদোকান চালিয়ে সংসার ও সবার পড়াশোনার খরচ দিয়ে কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।’

তানজিম আবার টিউশনি শুরু করেন। লক্ষ্য কম্পিউটার কেনা। ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে মাসে ৯ হাজার টাকা আয় করতেন। এক বছর পর ২০২১ সালে ৪২ হাজার টাকা দিয়ে একটা কম্পিউটার কেনেন। কেনার পর নতুন সমস্যায় পড়েন। তানজিম বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ তথ্যপ্রযুক্তি, ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সবাই আমাকে বলতেন, কম্পিউটার কিনে ভুল করছি। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্যে স্থির ছিলাম।’
বর্তমানে ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সার কাজ দেওয়া-নেওয়ার ওয়েবসাইট ফাইভআরে কাজ করছেন তানজিম। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ডিজিটাল বিপণন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুক ও গুগলের বিজ্ঞাপন নিয়ে তিনি কাজ করেন। প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলার আয় করেন। এর বাইরে মানিকগঞ্জে বসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দুটো কোম্পানির জন্যও কাজ করেন তিনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তানজিম বলেন, ‘একটা দল গঠন করতে চাই। সেই দল থেকে অন্তত ১০ জন যেন আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে।’ তানজিম রহমান যোগ করেন, নারীদের দৃঢ়তা, সাহস ও সমর্পণের প্রতি সবারই সম্মান জানানো প্রয়োজন।

আইরিন আক্তার
সংগৃহীত

দিনে চাকরি, রাতে ফ্রিল্যান্সিং—আইরিন আক্তারের দিনবদলের গল্প

নিজের জন্য একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনতে আইরিন আক্তারের লেগেছিল প্রায় এক বছর। সেই আইরিন এখন প্রতি মাসে আয় করেন প্রায় এক হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সোয়া এক লাখ টাকা। আইরিন আক্তার ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির কাজ করেন।

নেত্রকোনার বারহাট্টা ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আইরিন চলে যান গাজীপুরে। গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বাংলায় ২০১৮ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আইরিন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি পান গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজি স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজে।

কম্পিউটার চালাতে চালাতে ডিজিটাল বিপণন সম্পর্কে জানেন আইরিন। বিষয়টি তাঁর ভালো লেগে যায়। সময় পেলেই অনলাইনে এ বিষয়ের ভিডিও দেখেন। ফ্রিল্যান্সার হতে চাওয়ার আরেকটা কারণ—ছোটবেলা থেকেই স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। ফোনে ডিজিটাল বিপণনের নানা ভিডিও দেখতে দেখতে তিনি বুঝতে পারেন, কম্পিউটার ছাড়া এ কাজ শেখা যাবে না।

আইরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখনই সিদ্ধান্ত নিই, বেতনের টাকা জমিয়ে ল্যাপটপ কিনব। পরিবারকে চাপ দিতে চাইনি। টানা এক বছর কষ্ট করে চলে ৩০ হাজার টাকা জমালাম। প্রতি মাসে আমি আমার মা ও ভাইকে কিছু টাকা দিতাম। মাকে যখন একটা ল্যাপটপ কেনার কথা বললাম, তখন মা তাঁর সেই জমানো টাকা আমাকে দিলেন। আরও ১২ হাজার টাকা যোগ করে ৪২ হাজার টাকায় পুরোনো ল্যাপটপ কিনলাম। শুরু হলো আমার ফ্রিল্যান্সিং।’

নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার যশমাধব গ্রামে আইরিন আক্তারের বাড়ি। তাঁর বাবার নাম মো. ছদ্দু মিয়া। তিনি একজন কৃষক। মা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে আইরিন ছোট। যক্ষ্মায় আক্রান্ত বাবা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, তেমন কাজ করতে পারতেন না। টানা এক বছর পরিশ্রম করার পর সফলতার মুখ দেখেছেন আইরিন। তাঁর প্রথম কাজটি ছিল গুগল অ্যাডসের, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটি ছিল ২৯ হাজার টাকা। এটি ২০২০ সালের কথা। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় এক হাজার মার্কিন ডলারের বেশি।

নারী দিবস উপলক্ষে আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমি নারী, আমি কি এটা পারব! ওটা করতে পারব না—এই চিন্তাধারা নারীর সফলতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি পারব, আমাকে পারতে হবে।’