ইউরোপ সফটওয়্যারের জন্য যেসব দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ নেই

বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ

দেশে তৈরি সফটওয়্যারের ৩৪ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয় ১৩ শতাংশ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা থাকলেও যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বাকি দেশগুলোতে সফটওয়্যার রপ্তানি হয় মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ। ইউরোপে দেশে তৈরি সফটওয়্যারের রপ্তানি বাড়াতে সম্প্রতি অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও যুক্তরাজ্য সফর করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) একটি প্রতিনিধিদল। সফরকালে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ‘ফেস্টিভ্যাল অব সোর্সিং’ আয়োজনেও অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ সফরনিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারিকুর রহমান খান

প্রথম আলো: ইউরোপ সফরের উদ্দেশ্য কী ছিল?

রাসেল টি আহমেদ: সফটওয়্যার খাতে রপ্তানি একটা বড় বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন থেকে সফটওয়্যার রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছি। এ জন্য আমরা প্রথমেই সফটওয়্যার খাতের বাজার সম্প্রসারণে নজর দিয়েছি। আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশে তৈরি সফটওয়্যারের ৩৪ শতাংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয় ১৩ শতাংশ। যদি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইউরোপকে যোগ করি তাহলে রপ্তানির পরিমাণ হবে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই ইউরোপে আমাদের প্রযুক্তি সক্ষমতা তুলে ধরার মাধ্যমে নতুন বাজার তৈরি করাই ছিল এই সফরের মূল উদ্দেশ্য।

প্রথম আলো: যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ‘ফেস্টিভ্যাল অব সোর্সিং’–এ অংশ নিয়েছিল বেসিস। এ আয়োজন থেকে কোনো সুখবর এসেছে কি?

রাসেল টি আহমেদ: যুক্তরাজ্যে ৩৫ বছর ধরে ‘ফেস্টিভ্যাল অব সোর্সিং’ অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর আন্তর্জাতিক এ আয়োজনে টাইটেল সহযোগী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় বেসিসকে। আমাদের কাছে যখন প্রস্তাব এল তখন আমরা সুযোগটা লুফে নিলাম। ৫ ও ৬ জুলাই লন্ডনের একটি দ্বীপে দুই দিনের এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। পুরো দ্বীপটি সাজানো হয়েছিল বাংলাদেশ ও বেসিসের পতাকা দিয়ে। বিশ্ব দরবারে দেশের সফটওয়্যার খাতের সক্ষমতা তুলে ধরার জন্য এটি ছিল আমাদের জন্য বড় একটি সুযোগ। এ সময় চারটি অনুষ্ঠানে আমরা তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের প্রযুক্তি সক্ষমতা তুলে ধরেছি।

প্রথম আলো: কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?

রাসেল টি আহমেদ: সফটওয়্যার খাতের বড় বাজার ছিল ইউক্রেন। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের নাগরিকেরা এখন সফটওয়্যার খাতে কাজের বদলে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন ভারতের বিকল্প খুঁজছে। ফলে সফটওয়্যার খাতে এখন যথেষ্ট কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এখনো বাংলাদেশকে আইসিটি হাব হিসেবে চেনে না। আর তাই দেশগুলো সফটওয়্যার খাতের জন্য যে দেশগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এর অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের উন্নতি সম্পর্কে বিশ্বের অনেক দেশই ভালোভাবে জানে না। আর তাই এই সফরের মাধ্যমে আমরা সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা তুলে ধরেছি। আমি নিশ্চিত, আমরা যে তিন শ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি, সেগুলোর মধ্যে কম করে হলেও ৩০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতের সক্ষমতা অন্যদের কাছে তুলে ধরবে।

প্রথম আলো: বিশ্বে এখন দক্ষ প্রযুক্তিকর্মীর চাহিদা কম না বেশি?

রাসেল টি আহমেদ: একটা প্রবাদ আছে ‘যখন ঘাটে নৌকা ভেড়ে, তখনই উঠে যেতে হয়’। এই প্রবাদের সঙ্গে মিলিয়ে বলব, এখন আমাদের ঘাটে নৌকা ভিড়ে আছে। শুধু উঠে গেলেই হবে। বাংলাদেশে এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছি। স্লোভাকিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই মুহূর্তে ২০ হাজার লোকের কাজের চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাজ্যও বলেছে তাদের ১০ লাখ দক্ষ প্রযুক্তিকর্মী প্রয়োজন। এ সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশে এখন রিজার্ভের সমস্যা, ডলারের সংকট চলছে। যত দিন পর্যন্ত আমদানি থেকে রপ্তানি ব্যয় বেশি হবে, তত দিন এই সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে। সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে আমাদের আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি করতে হবে। আর রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সফটওয়্যার খাত হতে পারে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

প্রথম আলো: সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে?

রাসেল টি আহমেদ: বাংলাদেশের আইসিটি খাতে উন্নতির তথ্য দেশে দেশে প্রচার করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের চাহিদাও জানতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী বের হলেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উপযোগী দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে আমাদের জাভা, পিএইচপি, ডটনেট ডেভেলপার এবং গ্রাফিকস ও অ্যানিমেশন বিষয়ে দক্ষ কর্মী তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।

প্রথম আলো: ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কোন কোন খাতে?

রাসেল টি আহমেদ: ইউরোপের চারটি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডটনেট, জাভা, পিএইচপি ও গ্রাফিকস ডিজাইন কাজের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বিষয়গুলোতে আমাদের যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। ফলে আমরা চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে অনেকটা এগিয়েছি। এখন আমাদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা বুঝে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

প্রথম আলো: বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশে আনার কোন উদ্যোগ নিয়েছেন কি?

রাসেল টি আহমেদ: শুধু টেলিফোন বা অনলাইনে ব্যবসা হয় না। ব্যবসা করার জন্য সরাসরি কথা বলতে হয়। এ জন্য দেশে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদেশি প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এখন বেসিস জানে কোথায় এবং কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়। আমি আশা করছি, ইউরোপ সফরকালে বাংলাদেশের প্রযুক্তি সক্ষমতা তুলে ধরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে কমপক্ষে ৩০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করবে। এ জন্য সরকার, বেসরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলে একটা মহাপরিকল্পনা করতে হবে।

প্রথম আলো: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

রাসেল টি আহমেদ: ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতেও আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করেছি আমরা। ভবিষ্যতে আমাদেরও এ ধরনের আয়োজন করতে হবে।