আগে বিজ্ঞানে চমক ছিল, এখন চমক কমে গেছে: নেচার সাময়িকী

গবেষণাগারে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরাছবি: রয়টার্স

গত ১০০ বছরে বিজ্ঞানের অনেক চমক দেখা গেছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন থেকে শুরু করে হাল আমলের এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) চমক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ভাবনাচিন্তা বদলে দিচ্ছে। গত এক শতাব্দী পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, দারুণ সব বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের শেষ গন্তব্য বা পরিণতি কতটা অস্পষ্ট হতে পারে। শতবর্ষ আগে বেকেলাইট নামের পলিমার প্রাথমিক পর্যায়ের টেলিফোন তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সেই আদি আমলের ডায়ালওয়ালা টেলিফোন তৈরি করা হতো। আবিষ্কারের এক শতাব্দী পর প্লাস্টিক দূষণ অবসানের জন্য এই পলিমার বন্ধ করতে বিজ্ঞানীরা সম্মত হয়েছেন। বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। গত এক শতাব্দীর বিভিন্ন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বিশ্লেষণ করে সেই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সময় যত এগোচ্ছে, বিজ্ঞান তত কম চমক তৈরি করছে।

বিংশ শতাব্দীর সূচনা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের তুমুল বিপ্লবের মাধ্যমে। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। সেই পথ অনুসরণ করে আমরা দেখতে পাই আলবার্ট আইনস্টাইনের চমকানো সব ধারণা। ১৯০৫ সালে তিনি ফটো ইলেকট্রিক প্রভাব, ব্রাউনিয়ান মোশন, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব আর তার বিখ্যাত ভর-শক্তির সূত্র সম্পর্কে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশের পরে বদলে যায় বিজ্ঞানের দুনিয়ার চায়ের আড্ডা। পরবর্তী দশকগুলোতে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রেও চমক ও দ্রুত বিকাশ দেখা যায়। ১৯১০ সালে মার্কিন জিনতত্ত্ববিদ থমাস হান্ট মরগ্যান ক্রোমোজোমে জিনের অবস্থান দেখানোর জন্য ফলের মাছির ড্রোসোফিলা ব্যবহার করেন। আধুনিক জেনেটিকসের পথে নতুন পথ দেখান তিনি। একই বছর মেরি কুরি সফলভাবে বিশুদ্ধ রেডিয়াম বিচ্ছিন্ন করেন। ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান নৃবিজ্ঞানী রেমন্ড ডার্ট অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস প্রজাতির স্তন্যপায়ী নিয়ে গবেষণা প্রকাশ করেন। একটি খুলির অংশবিশেষ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন, আফ্রিকা থেকেই মানবজাতির বিকাশ ঘটে।

আরও চমকানো সব আবিষ্কার গত শতাব্দীর শুরুতে দেখা যায়। ১৯০৭ সালে বেলজিয়ামের রসায়নবিদ লিও বেকেল্যান্ড একটি উদ্ভাবনকে বাণিজ্যিকীকরণ করেন। যাকে তিনি বেকেলাইট নামে অভিহিত করেন। আজকের প্লাস্টিকের অগ্রদূত বলা হয় একে। উপাদানটি হাইড্রোকার্বন অণুর দীর্ঘ ও অবিচ্ছেদ্য শিকল দিয়ে তৈরি হয়। এটিতে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয় না, সহজে গলানো যায়, তাপ প্রতিরোধী ও রঙিন করা যায় সহজেই। এ ছাড়া ১৯০৯ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিটজ হ্যাবার অ্যামোনিয়া উৎপাদনের জন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ও তার সহযোগী রসায়নবিদ কার্ল বোস ১৯১৩ সালে বাণিজ্যিকীকরণ করেন এই প্রযুক্তি। তাদের উদ্ভাবিত বায়ু থেকে নাইট্রোজেন ব্যবহার করে অ্যামোনিয়া তৈরির প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। সেই উদ্ভাবন আজও বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।

এখন বৈজ্ঞানিক দুনিয়ার গতি অনেক বদলে গেছে। যাদের বয়স ১০০ বছরের মতো, তাঁরা এই চমক বুঝতে পারছেন। এখনকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে বিশাল বিশাল দল কাজ করছে। আর্থিক সহায়তা ও পরীক্ষাগার দেখে সেই আমলের পুরোনো বিজ্ঞানীরা চমকে যেতেন। উদ্ভাবনকে এখন দ্রুত সমাজের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। গবেষণাপত্র প্রকাশের দৌড়ও দেখা যায়। বর্তমানের বেশ কিছু আবিষ্কার চমক জাগানো হলেও বিজ্ঞানের জন্য নতুন দিকনির্দেশনা প্রদানের মতো বড় নয় বলে নেচার সাময়িকী মনে করে।

বিজ্ঞান ও সমাজ গত এক শ বছরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। নেচার সাময়িকীতে ভবিষ্যতের আবিষ্কার কেমন হবে তা নিয়ে সম্প্রতি সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত শতাব্দীর আবিষ্কার প্লাস্টিক ও কৃত্রিম সার ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে এখন অনেক সমালোচনা হয়। বিভিন্ন দেশ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্ষতি সীমিত করার জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে চুক্তি করেছে। বেকেল্যান্ড পলিমারের দূষণ সীমিত করার জন্য আলোচনা চলছে। অ্যামোনিয়া উৎপাদনের প্রক্রিয়ার ক্ষতি কমাতে দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তি চালু রয়েছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তির মতো সাম্প্রতিক উন্নয়ন বৈশ্বিক কোনো চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এই শতকের এসব আবিষ্কার এমনভাবে প্রয়োগ করা দরকার, যাতে তাদের ক্ষতি করার আশঙ্কা কম থাকে। বিশ্বব্যাপী সমন্বিত চুক্তির মাধ্যমে এসবের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছে নেচার সাময়িকী।

সূত্র: নেচার