এখনো ছবি তোলা থেমে নেই সাইদা খানমের

>
নিজের তোলা ছবির সামনে ছবিমেলার আজীবন সম্মাননা স্মারক হাতে আলোকচিত্রী সাইদা খানম l ছবি: কবির হোসেন
নিজের তোলা ছবির সামনে ছবিমেলার আজীবন সম্মাননা স্মারক হাতে আলোকচিত্রী সাইদা খানম l ছবি: কবির হোসেন
বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম। ছবিমেলার নবম আসরে তাঁকে দেওয়া হলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সত্যজিৎ রায়, রানি এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, সুফিয়া কামাল, নিল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন, মাইকেল কলিন্সসহ বিখ্যাত মানুষদের ছবি সাইদা খানম তুলেছেন তাঁর ক্যামেরায়।

হাসছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল যেন কিশোরী এক মেয়ে হেসে উঠল। ভাইবোনদের কথা বলার সময় হয়ে উঠছিলেন বাড়ির ছোট মেয়ে। আবার কাজের কথা বলতেই তাঁর স্বরূপে ফিরে এলেন। বয়স আশির কাছাকাছি পৌঁছালেও ক্যামেরা ছাড়েননি।

শেষ কবে ছবি তুলেছেন? ‘এই তো কয়েক দিন আগে। জানালার ধারে একটা পাখি এসে বসেছিল। আমার কোডাক ক্যামেরা দিয়ে সেটা তুলেছি। এখন তো বাইরে একা হাঁটাচলা করতে পারি না। তাই বলে ছবি তোলা তো থেমে থাকবে না।’ সাইদা খানমের বনানীর বাড়িতে কথা হচ্ছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছিলেন। সারা দিন কাটে কী করে? ‘বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি। গান শুনি।’ এই মুহূর্তে পড়ছেন জমিয়ে রাখা শারদীয় পূজা সংখ্যার একটা ম্যাগাজিন।

সত্যজিৎ​ রায়কে নিয়ে সাইদা খানমের লেখা ব​ইয়ের প্রচ্ছদ, সাইদা খানমকে লেখা সত্যজিৎ​ রায়ের চিঠি
সত্যজিৎ​ রায়কে নিয়ে সাইদা খানমের লেখা ব​ইয়ের প্রচ্ছদ, সাইদা খানমকে লেখা সত্যজিৎ​ রায়ের চিঠি

ক্যাসেট প্লেয়ার যন্ত্রটার দেখা মেলা ভার এখন। সাইদা খানম সেই ক্যাসেট প্লেয়ারেই গান শোনেন। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ঝন্টু বের করে দেখালেন, অনেক ক্যাসেট রয়েছে সংগ্রহে। লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেটই চোখে পড়ল। রবিঠাকুরের লেখা পছন্দ সেই ছোটবেলা থেকে। তাঁর বড় ভাই ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। মা-বাবা দুজনেই প্রগতিশীল মানসিকতার ছিলেন। তাঁর খালা মাহমুদা সিদ্দিকা সেই সময় কবিতা লিখতেন। তিনিও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
৬৫ বছর আগে ক্যামেরা হাতে একজন মেয়ে রাজপথ থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্দরমহল—সবখানেই স্বপ্রতিভ হয়েছিলেন। শেখার সুযোগ ছিল কম। ঢাকায় সে সময় জায়েদী নামে একটি ফটো স্টুডিও ছিল। স্টুডিওটির স্বত্বাধিকারী সাইদা খানমের ছবির কম্পোজিশন পছন্দ করতেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি থেকে ছবির বিভিন্ন ম্যাগাজিন এনে রাখতেন। দুটি শব্দ মনে রাখতে বলেছিলেন সাইদা খানমকে—এক্সপোজার ও অ্যাপারচার। বাকিটার জন্য নিজেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছেন।

ক্যামেরা হাতে
ক্যামেরা হাতে

‘পরিবার থেকে সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন। বিশেষ করে বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন না পেলে এই পেশায় টিকে থাকতে পারবে না। মেয়ের মা-বাবা যদি দেখেন তাঁদের সন্তান প্রতিভাবান, সেটি বিকাশ হওয়ার সুযোগ তাকে দেওয়া উচিত। তাঁদের উদার দৃষ্টি থাকতে হবে। মেয়েকেও মা-বাবাকে বোঝাতে হবে।’ বললেন সাইদা খানম। তবে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতে গেলে একই সঙ্গে কায়িক ও মানসিক দুই ধরনের পরিশ্রমই হয়। তাই সুস্থ থাকা জরুরি।
এই নারী আলোকচিত্রীকে পেরোতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা। রানি এলিজাবেথ এসেছিলেন ঢাকায়। সাঈদা খানম গিয়েছিলেন বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের কাছে। বলেছিলেন, একটা না একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। নূরজাহান বেগম বলেন তথ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে। মেয়ে বলেই সেখানকার কর্মকর্তারা অনেক দিন ঘুরিয়েছিলেন সাঈদা খানমকে। শেষ পর্যন্ত অনুমতি পেয়েছিলেন, মনে হয়েছিল সেটাই বড় অর্জন।
আরেকবার কলকাতা থেকে প্রখ্যাত একজন লেখক এসেছিলেন। সেই লেখকের স্ত্রী ছিলেন তাঁর বোন হামিদা খানমের বান্ধবী। তাঁর পরিচয়ে গিয়েছিলেন লেখকের ছবি তুলতে। ‘আমি তাঁকে বললাম, একটা ছবি তুলতে পারি? তিনি উত্তরে না বললেন। ভেবেছিলাম, অনেকে তো না বলে, ছবি তোলার পর কিছু বলে না। ছবি তোলার জন্য ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে ওঠামাত্রই সেই লেখক ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ফ্ল্যাশলাইট ভেঙে ফেললেন। খুব কেঁদেছিলাম।’ বললেন সাইদা খানম।

১৯৮২ সালে কাশ্মীরের পাইন বনে সাইদা খানম
১৯৮২ সালে কাশ্মীরের পাইন বনে সাইদা খানম

এমন কত শত গল্প আছে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁর মধ্যে বিশেষভাবে বলতে চান সত্যজিৎ রায়ের কথা। সাইদা খানমের ‘মানিকদা’। ‘মানিকদা ও তাঁর স্ত্রী মঙ্কুদি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। নিখাদ, নিঃশর্ত ভালোবাসা। আমার ডাক নাম বাদল। তাঁরা আমাকে সে নামেই ডাকতেন। মানিকদা যখন খুব অসুস্থ, কাউকেই চিনতে পারতেন না। সেই সময় হাসপাতালে গিয়েছিলাম দেখতে। আমি তাঁর রুমে ঢোকামাত্রই আমাকে দেখে বললেন, কেমন আছো, বাদল? তাঁর চারুলতা সিনেমার শুটিংয়ের সময় অন্য কাউকে থাকতে দেননি আমাকে ও আরেক ব্রিটিশ আলোকচিত্রীকে ছাড়া।
মজা করে হেসে সাঈদা খানম বললেন, ‘ছবিটা মনে হয় খারাপ তুলতাম না। তাই হয়তো এত ভালোবাসতেন।’
সাইদা খানমের বয়স তখন ১৪ বছর। এক বন্ধুর সঙ্গে কলকাতায় ‘লাইফ’ নামে একটি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে বড় বড় দেয়ালজুড়ে টাঙানো ছবি দেখে নিজের মধ্যে একটা উপলব্ধি হয়। সঙ্গে থাকা সেই বন্ধুকে বলেছিলেন, আলোকচিত্র শুধু আলোকচিত্র নয়, এটা একটা শিল্প। বন্ধু তর্ক করেছিলেন। বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি ছবি তুলে নিজেই প্রমাণ করে দেব আজকের কথাটা।’
সাইদা খানম তাঁর এই দীর্ঘ কর্মজীবনে সেটি প্রমাণ করে দিতে পেরেছেন।

মাদার তেরেসার সঙ্গে
মাদার তেরেসার সঙ্গে