এক পিরামিড-সমান মুগ্ধতা নিয়ে...

বিভিন্ন দেশের তরুণেরা অংশ নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থা আইজেক আয়োজিত এই প্রকল্পে। মিসরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখেন তাঁরা।
বিভিন্ন দেশের তরুণেরা অংশ নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থা আইজেক আয়োজিত এই প্রকল্পে। মিসরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখেন তাঁরা।

দিনটি ছিল ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ। সকাল ৯টার ফ্লাইট কুয়াশার কারণে ছাড়ল বেলা ১টায়। গন্তব্য, পিরামিডের দেশ—মিসর। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা আইজেকের সঙ্গে ছয় সপ্তাহের একটি প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে মিসরে পাড়ি জমাই আমরা তিনজন। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ থেকে আমি ও আকিব আল ওয়াদুদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আতিক রাফি।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশের তরুণদের নিয়ে ৭০ বছর ধরে কাজ করছে আইজেক। এর উদ্দেশ্য, বিশ্বের সব দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। আইজেকের ওয়েবসাইটে (aiesec.org) গিয়ে নিজের পছন্দের প্রকল্পটি বেছে নিয়ে অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হলে পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট প্রকল্পের ব্যবস্থাপক অনলাইনে ভিডিও কলের মাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার নেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয় এক দিনের মধ্যেই।

আমাদের দলটি ছিল ৩০ জনের। বাংলাদেশ ছাড়াও এই প্রকল্পে অংশ নেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, ফ্রান্স, গ্রিস ও ব্রাজিলের শিক্ষার্থীরা। আমাদের কাজ ছিল প্রধানত মিসরের ট্যুরিজম নিয়ে লেখা এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রচার করা। চারটি দলে ভাগ করা হয় আমাদের৷ ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ব্লগিং ও প্রচারণা। আমাদের লেখা ও ছবি ছাপানো হতো মিসরের বিভিন্ন ওয়েবসাইট। ছয় সপ্তাহের মিসর ভ্রমণে প্রথম দুই সপ্তাহ রাজধানী কায়রোতে অবস্থান করে সেখানকার প্রধান ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ঘুরে দেখি আমরা। এর মধ্যে দুই সপ্তাহ ঘুরেছি আরও নয়টি শহর। শেষ দুই সপ্তাহে আবার কায়রোতে ফিরে তৈরি করতে হয়েছে যাঁর যাঁর কাজের চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ মিসরের কথা কে না জানে, তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে দেশটি যে এতটা বৈচিত্র্যময় তা হয়তো অনেকেরই অজানা। পাথুরে বালুর মরুভূমির দেশ মিসরের সভ্যতা গড়ে উঠেছে নীলনদকে ঘিরে। তার তীর ঘেঁষে আমাদের প্রথম যাত্রা শুরু হয় ‘লুক্সরের’ পথে। ছিমছাম শহরটিতে নদের দুই পাড়েই রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী বিভিন্ন প্রাসাদ। কল্পনাতীত বিশাল প্রাসাদগুলোর কারুকাজ যতটা চমৎকার, তার চেয়েও চমৎকার সেখানকার সিংহাসনের ইতিহাস।

এক ভোরবেলা আমরা বেরিয়ে পড়ি ‘হট এয়ার বেলুনে’ ১০০০ ফুট উঁচু থেকে সূর্যোদয় ও আকাশপথে লুক্সর দেখতে। খোলা আকাশের নিচে শিরশিরে ঠান্ডা বাতাসে সত্যিই পাখির মতো ভেসে বেড়াই আমরা। সূর্যের প্রথম রশ্মি আকাশের বুকে আমাদের স্বাগত জানায়।

পরের গন্তব্য আসওয়ান। সারা দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করে নদীপথে ভ্রমণ করি আমরা। নীলনদের মাঝামাঝি এক দ্বীপে যাত্রাবিরতিতে নদীতে সাঁতার কাটে অনেকেই। আমরা কয়েকজন সে সময় ঘুরে দেখি ছোট্ট দ্বীপটি। শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। হাতে গোনা কয়েকটি মাটির ঘর আর প্রতিটি ঘরের দেয়ালে রংবেরঙের নকশা করা। পড়ন্ত বিকেলের লাল আলোয় রঙিন গ্রামটিকে কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত ছবির মতো লাগছিল। এরপর ‘আবু সিম্বলে’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদগুলোর একটির দেখা পাই। ‘লেক নাসির’ নামে হ্রদটির তীরে আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ দেখে এটিকে সমুদ্র ভেবে ভুল হতে পারে।

 ‘মারসা আলম’ ও ‘হুরঘাদা’য় পৌঁছালে শুরু হয় আমাদের সমুদ্র দর্শন। লোহিত সাগরের পানি এতই নীল যে তা আকাশকেও হার মানায়। দিনব্যাপী সমুদ্র ভ্রমণ করি আমরা। সেখানেই প্রথমবার অভিজ্ঞতা হয় ‘স্কুবা ডাইভের’। সমুদ্রের নিচে এক অন্য পৃথিবী, যার রূপ নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। স্বচ্ছ পানিতে রঙিন মাছের খেলা দেখি আমরা। দিন শেষে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয় সমুদ্রতীরে তাঁবুতে। রাতে পরিষ্কার দেখা না গেলেও পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে যায় ঢেউ আর শিয়ালের ডাকে। যখন তাঁবু থেকে বের হই, চোখের সামনেই শান্ত নীল সমুদ্র, যাকে কয়েক পা এগোলেই ছোঁয়া যাবে। ভোরের মিষ্টি বাতাস আর দিনের প্রথম আলোয় যেন এক সুন্দর স্বপ্নে ঢুকে পড়েছিলাম।

সেইন্ট ক্যাথরিন আড়াই ঘণ্টা হেঁটে সিনাই পর্বতের চূড়ায় পা রাখি আমরা। মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাত কাটিয়ে সূর্যোদয় দেখে ফিরে আসি শহরে। দাহাব, আলেকজান্দ্রিয়া ও সিওয়াতেও সময় কাটে ভূমধ্য আর লোহিত সাগরের সঙ্গে। দাহাবের ‘হোয়াইট ক্যানিয়ন’ একটি গভীর খাদ যার রং ধবধবে সাদা। প্রায় ২০ তলা ভবনের সমান গভীর খাদে দড়ি আর মইয়ের সাহায্যে প্রবেশ করি আমরা। সেখানে সাদা পাথরের দেয়ালে সূর্যের আলো চোখ ধাঁধানো এক রঙের সৃষ্টি করে। কোথাও চাপা, কোথাও প্রশস্ত উঁচু–নিচু পাথুরে রাস্তা দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা গিয়ে পৌঁছাই একটি বেদুইন গ্রামে। সেখান থেকে গাড়িতে করে ফিরে আসি হোটেলে।

আর হ্যাঁ, ভাববেন না মিসর গিয়ে পিরামিড না দেখেই ফিরে এসেছি! পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় স্থান করা এই নিদর্শনের সামনে যতক্ষণ ছিলাম, চোখ সরাতে পারিনি। রহস্যময় ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে সে পৃথিবীকে দেখিয়ে চলছে মিসরের হাজার বছরের ইতিহাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মিশর রহস্য’ নামটি সত্যিই সার্থক। ৩ ফেব্রুয়ারি এক পিরামিড–সমান মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসি বাংলাদেশে।