হার না মানা তাসলিমা

‘রাঁধুনী কীর্তিমতী হিতৈষী-২০১৮’ সম্মাননা স্মারক হাতে তাসলিমা ফেরদৌস
‘রাঁধুনী কীর্তিমতী হিতৈষী-২০১৮’ সম্মাননা স্মারক হাতে তাসলিমা ফেরদৌস

তাসলিমা ফেরদৌস তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ডানামেলা কৈশোর। অতটুকুন বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে, এ ছিল না ভাবনায়। পরিবারের সদস্যরা অনেকটা জোর করেই বিয়ে দিলেন তাসলিমা ফেরদৌসের। পড়াশোনা থমকে দাঁড়াল। ১৯৭৭ সালের কথা সেটা।
কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী নন তসলিমা। ঘরকন্নার কাজ করতে করতেই স্বপ্নপূরণের প্রতিজ্ঞা করলেন। পুলিশ কর্মকর্তা স্বামী মাহবুব আলমের সহযোগিতায় ভর্তি হলেন স্কুলে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় নিলেন স্নাতক ডিগ্রি। সেই তাসলিমা এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। অসহায় মানুষ আর প্রবীণদের আশ্রয়। তাঁর ব্যবসার আয়ের টাকায় নওগাঁয় পরিচালনা করেন একটি প্রবীণ নিবাস কেন্দ্র।
এমন মানবহিতৈষী কাজের জন্যই এ বছর ‘রাঁধুনী কীর্তিমতী হিতৈষী-২০১৮’ সম্মাননা পেয়েছেন তাসলিমা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৯ উপলক্ষে বিভিন্ন অঙ্গনে অনন্য অবদান রাখা নারীদের সম্মানিত করে স্কয়ারের রাঁধুনী। তাসলিমা ছাড়াও কীর্তিমতী উদ্যোক্তা বিভাগে কোহিনূর ইয়াসমীন, কীর্তিমতী সাংবাদিক বিভাগে রোজী ফেরদৌস, কীর্তিমতী ক্রীড়াবিদ বিভাগে ক্রিকেটার সালমা খাতুন সম্মানিত হয়েছেন।
তাসলিমা ফেরদৌস বলেন, ‘একপ্রকার যুদ্ধ করেই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠেছি, লেখাপড়া করেছি। আমার এক মেয়ে ও এক ছেলে। লেখাপড়া করা অবস্থায় তাঁদের জন্ম হয়। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্বপ্নকে কখনো মরতে দিইনি। নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, সমাজের অসহায় নারীদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
তাসলিমা যখন কিশোরী তখন থেকেই সমাজের বিভেদ আর অসংগতি তাঁর কোমল প্রাণে আঁচড় কাটে। ছোটবেলা কেটেছে নওগাঁ শহরেই। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, আশপাশের প্রতিবেশীর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে না। তাঁদের বাবা-মায়ের এ নিয়ে কোনো তাগিদ নেই। একসময় খেলাধুলা ও হুইহুল্লোড় করে বেড়ানো এসব ছেলেমেয়ের বাড়িতে স্বেচ্ছাশ্রমে অক্ষরজ্ঞান শেখাতে শুরু করেন তিনি। এ ছাড়া তিনি দেখতে পান, অল্প বয়সে গ্রামের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং অনেক গৃহবধূ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তখন থেকেই সমাজের এই সব অসহায় নারীর জন্য একটা কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি।
শ্বশুরবাড়ি থেকে স্বামীর কর্মস্থল ১৯৭৯ সালে রংপুর থাকতে শুরু করেন তাসলিমা। এরপর বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে তাঁকে। রংপুরে পুলিশ পরিদর্শক স্বামীর কোয়ার্টারে থাকা অবস্থায় স্বামীর সহকর্মীদের স্ত্রীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। এই সব নারী কর্মীকে নিয়ে সূচিশিল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও অসহায় নারীদের সাহায্যের জন্য গড়ে তোলেন, ‘হেল্প হিউম্যান এসেনমশিয়াল লার্নিং ফর প্রোগ্রেস’ নামের একটি সংগঠন। সমাজের অসহায় নারীদের সহযোগিতার পাশাপাশি শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘শিশু শিক্ষালয়’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। রংপুরে থাকা অবস্থায় ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি শিশু শিক্ষালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
স্বামীর বদলির কারণে বগুড়া থাকা অবস্থায় কুটির শিল্প ও সূচিশিল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। সেখানে কলেজ ছাত্রী ও গৃহিণীদের নিয়ে প্রায় ২০০ কর্মী গড়ে তোলেন। তাসলিমা নিজেই পোশাকের ডিজাইন করতেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করতে শুরু করেন এবং বেশ সাড়া পান।

বেলাশেষে
একসময় স্বামীর কর্মস্থল ও ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য তাসলিমা পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে একটি ব্যাংকে চাকরি হয় তাঁর। যোগ্যতাবলে খুব দ্রুতই চাকরিতে পদোন্নতি পান তিনি। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে ছিল উদ্যোক্তা হয়ে সমাজ উন্নয়নে এবং মানবকল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন। ২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুরে শিয়ালবাড়িতে সমাজের আরও কিছু সুহৃদ ব্যক্তির সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘বেলাশেষে’ নামের একটি প্রবীণ নিবাস কেন্দ্র। শুরু হলো মানবকল্যাণে নিজের মতো কাজ করা। ২০ জন প্রবীণ মায়ের সেবা দিয়ে শুরু হয় প্রবীণ নিবাস কেন্দ্রটি। শুরুতে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েও যাঁরা সামাজিকভাবে অসহায়, সেই সব মায়ের সেবা দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে অসচ্ছল মায়েদেরও সেখানে বিনা মূল্যে সেবা কার্যক্রম দেওয়া শুরু হয়।
২০১১ সালে তিনি ফিরে আসেন জন্মস্থান নওগাঁ শহরে। শুরুতে নওগাঁ শহরের কাজীপাড়ায় একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বেলাশেষের কার্যক্রম শুরু করেন। একপর্যায়ে ঢাকার বেলাশেষে পায় নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নে ইলশাবাড়িতে নিজের একখণ্ড জমি। বর্তমানে ওই জায়াগায় ‘বেলাশেষে’ প্রবীণ নিবাস কেন্দ্র অবস্থিত। এই প্রবীণ নিবাস কেন্দ্র পরিচালনা ছাড়াও নারী উন্নয়ন কেন্দ্র নাম দিয়ে তাঁর বুটিক ও বাটিকের সূচিশিল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। সেখানে এলাকার অসহায় নারীর কর্মসংস্থান হয়। এর পাশাপাশি তাসলিমা ফেরদৌস বর্তমানে নওগাঁ ও সান্তাহার শহরে ‘আড্ডা-১ ’; ‘আড্ডা-২’ ও ‘ভোজন’ নামের তিনটি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছেন। তাঁর এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে নিয়মিত ২৫-২৬ জন কর্মী কাজ করেন। তাসলিমা প্রথম আলো নওগাঁ বন্ধুসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসবের পাশাপাশি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি
তাসলিমা বলেন, ‘নওগাঁয় যখন বাসা ভাড়া নিয়ে বেলাশেষের কার্যক্রম চালাতে গিয়ে শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছি। অনেকে অপপ্রচার ছড়াতে শুরু করে বৃদ্ধা মায়েদের সেবা দেওয়ার নাম করে এই মহিলা কিডনি পাচারের ব্যবসা করছে। তবে বেলাশেষে টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় অনেক ভালো মানুষকে আমি তখন পাশে পেয়েছি। যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ময়নুল হক দুলদুল ও প্রকৌশলী ইকবাল হাসান খানের নাম না বললেই নয়। তাঁরা আমাকে তখন অনেক সহযোগিতা করেছেন।’
আদরের সন্তান কি কখনো মা-বাবার বোঝা হয়? বাবা-মা কত আদরে, সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে, শুধু সন্তানের ভালোই চেয়ে যান আজীবন। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে কীভাবে সেই সন্তানের কাঁধে বোঝা হয়ে যায়, তার নির্মম হিসাব কষা দায়। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে মনের মধ্যে তাদের জন্য কিছু করার সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অদম্য ইচ্ছাতেই “বেলাশেষে’’র জন্ম।’ তাঁর ইচ্ছা, সব ছেলেমেয়ে তাঁদের বাবা-মায়ের দেখাশোনা করুন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের যেন বৃদ্ধাশ্রমে আসতে না হয়। তারপরেও যাঁরা একেবারে অসহায়, তাঁদের জন্য বেলাশেষের দরজা সব সময় খোলা।