সাইকেলের চাকায় জীবনের জয়গান

>মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা মৌসুমি। তাঁর হাতেই গড়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জের নারী সাইকেলচালকদের সংগঠন ‘নভেরা’। যে সংগঠনের কাজে যুক্ত হয়েছেন শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী, গৃহিণী, শিক্ষকসহ প্রায় চার শতাধিক সদস্য। প্রতি মাসে তাঁরা নারীদের সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের অধিকার–সচেতন করেন, তাঁরা সোচ্চার প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার কাজেও।

দুঃসময়ের দিনগুলো এখনো তাড়া করে ফারজানা মৌসুমিকে। আনমনে যেন হারিয়ে যেতে বসেন ঘরবন্দী দিনের স্মৃতিতে। সেদিনও যেমন ডুবেছিলেন কষ্টের দিনে। বলছিলেন তা দুঃখমাখা কণ্ঠে, ‘মেয়েদের ঘরবন্দী করে রাখাকেই মা-বাবারা নিরাপদ মনে করেন। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিল। একেবারেই ঘরবন্দী ছিলাম। স্কুল-কলেজের ফল ভালো। ২০০৯ সালে একটি বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হই। কিন্তু বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি। নানা কারণে হতাশা গ্রাস করে। আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছি। একপর্যায়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিই। এভাবে টানা পাঁচ বছর জীবন থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি।’

তবে সেদিন কথায় কথায় বদ্ধ জীবনের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, শোনালেন আত্মপ্রত্যয়ের কথা। একজন বলিষ্ঠ আর স্বপ্নবান তরুণের কণ্ঠে ফুটে উঠল ডানামেলা রঙিন ভবিষ্যতের কথা। যার শুরুটা তাঁর কথায় এভাবে ধরা পড়ল, ‘একসময় নতুন করে জীবন শুরুর স্বপ্ন দেখি। জীবনের নতুন লড়াইয়ে সঙ্গী হয়ে ওঠে সাইকেল। এখন মনে হয়, এই সাইকেলই আমাকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।’ 

২০১৭ সালে সাইকেল নিয়েই তিনি গড়ে তুললেন একটি সংগঠন। নাম দিলেন নভেরা। নারায়ণগঞ্জ নগরের শেখ রাসেল পার্কে বসে সেই ‘নভেরা’র কথাই শুনি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা মৌসুমির কাছে। যে সংগঠনের মাধ্যমে সাইক্লিংয়ে আগ্রহী নারীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করছেন তিনি ও তাঁর গড়া সংগঠন।

ফারজানা মৌসুমি। ছবি: দিনার মাহমুদ
ফারজানা মৌসুমি। ছবি: দিনার মাহমুদ

নভেরার শুরু
ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা থেকে প্রায় পাঁচ বছর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটান ফারজানা মৌসুমি। পড়াশোনা বন্ধ ছিল। ২০১৪ সালে লক্ষ করেন, তাঁর সহপাঠীরা এমবিবিএস শেষ করেছেন। সেসব বন্ধুর উচ্ছ্বাস দেখে নতুন করে জীবন শুরু করার ইচ্ছে হয় মৌসুমির। তিনি বলেন, ‘টানা পাঁচ বছর ঘরবন্দী ছিলাম। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা লক্ষ করলাম। শারীরিক সুস্থতার জন্যই বন্ধুদের কাছে সাইকেল চালানো শিখি। সেই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টাতে মার্শাল আর্টও শিখি। পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে ছিলাম “সমগীত পাঠশালা” নামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি স্কুলে।’

শুরুতে নারায়ণগঞ্জের নারীদের মধ্যে একা সাইকেল চালাতেন মৌসুমি। প্রতি শুক্রবার সাইকেল নিয়ে বের হতেন। নারায়ণগঞ্জের ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে সাইকেল চালাতে দেখে নারীদের নিয়েও একটি দল গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এর মধ্যে অনেক মেয়েই মৌসুমির কাছে সাইকেল চালানো শেখার আগ্রহের কথা জানান। ২০১৬ সাল থেকে আগ্রহীদের সাইকেল চালানো শেখাতে শুরু করেন তিনি। সবাই মিলে দুটি সাইকেল কেনেন। ধীরে ধীরে নারী সাইকেলচালকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে সংগঠনের জন্য নাম খুঁজতে থাকেন মৌসুমি ও তাঁর বন্ধুরা। প্রথমে ঠিক করেন ‘টু হুইলার গার্লস অব নারায়ণগঞ্জ’। পরে বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর নভেরার জীবনসংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাম রাখেন ‘নভেরা’।

নভেরার যত কাজ

সম্প্রতি প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচানোর আহ্বান জানিয়ে একটি সাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজনের পর দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পায় নভেরা। শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী, গৃহিণী, শিক্ষকসহ বর্তমানে তাদের চার শতাধিক সদস্য। নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের পেছনের সড়কে প্রতি মাসে তিন দিনব্যাপী সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেয় সংগঠনটি। আগ্রহী যেকোনো নারী অংশ নিতে পারেন এ প্রশিক্ষণে। এ পর্যন্ত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় ২০০ নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার স্লোগান-সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতি মাসে দুবার সাইকেল ভ্রমণে বের হন নভেরার সদস্যরা।

পথটা মসৃণ নয়

‘সাইকেল চালাতে গিয়ে কখনো বাধা আসেনি?’—এমন প্রশ্নে মৃদু হাসেন মৌসুমি। শান্ত গলায় উত্তর দেন, ‘শুরুতে মেয়েদের কাছে কেউ সাইকেল ভাড়া দিতেন না। ভাড়া দিলেও ছেলেদের তুলনায় দ্বিগুণ টাকা দিতে হতো। সাইকেল নিয়ে বের হলেই আশপাশের মানুষের বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাইকেল ঘেঁষে গাড়ি চালায়। এগুলো একসময় যন্ত্রণা দিত।’ 

নভেরার সদস্যদের সাইকেল শোভাযাত্রায় থাকে সচেতনতার বার্তা।
নভেরার সদস্যদের সাইকেল শোভাযাত্রায় থাকে সচেতনতার বার্তা।

সেসব বাধা জয় করতেই তাঁরা পথে নেমেছিলেন। ধীরে ধীরে সংগঠিত হন, নিজেরাই তৈরি করে নেন পথ। এভাবেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছে মৌসুমির নভেরা। তবে প্রশিক্ষণের জন্য স্থানসংকটের ঝামেলায় এখনো পড়তে হয়। সেদিনই ফারজানা মৌসুমির আলাপের সময় বিষয়টি যোগ করেন নভেরার প্রশিক্ষক আফরিন হিয়া। তিনি জানান, আগ্রহীদের সাইকেল চালানো শেখানোর জায়গা পাচ্ছেন না তাঁরা। নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের সাইকেল শেখানোর সময় প্রায়ই তাঁদের বের করে দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণের স্থান–সংকটের বিষয়টিসহ নভেরার কার্যক্রম নিয়ে কথা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে। সংগঠনটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নারীরা পরিবেশবান্ধব সাইকেল নিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচানোর আহ্বান জানাচ্ছে। এটা খুবই ইতিবাচক।’ নভেরার প্রশিক্ষণের জন্য জিমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়ামের এক পাশে জায়গা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

নভেরার আহ্বান

বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তিতে বলীয়ান নভেরার সদস্যরা সমস্যা পাশে রেখে দেখছেন সম্ভাবনার স্বপ্ন। ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে সাইক্লিং কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক পরিসরে কাজ করতে চায় নভেরা। যেমনটি বলেন মৌসুমি, ‘আরও বেশি মেয়েদের যুক্ত করার জন্য স্কুলভিত্তিক প্রশিক্ষণ শুরু করতে চাই। মানুষের সঙ্গে সরাসরি প্রাণ–প্রকৃতি নিয়ে কথা বলতে চাই। বড় বড় শোভাযাত্রা আয়োজন করে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করতে চাই।’ সেই সঙ্গে তিনি আহ্বান জানান মেয়েদের সাইকেলে করে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার। বলেন, ‘সাইকেল মেয়েদের জড়তা ও ভয় দূর করে। নিয়মিত সাইকেল চালানো যেমন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তেমনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই সময়ে সাইক্লিং হতে পারে পরিবেশ রক্ষার প্রথম হাতিয়ার।’

তাই তো এই সাইকেলেই নারীদের বাধাহীন সমাজের স্বপ্নও দেখেন ফারজানা মৌসুমি।