নিজেকে একটা ব্র্যান্ড বানাতে হবে

>আবদুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু আইসক্রিম, ডেইরি ও ফুডের গ্রুপ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জি এম কামরুল হাসান। প্রায় ২৫ বছরের পেশাজীবনে তিনি রহিমআফরোজ, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, প্রাণের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে প্রতি সপ্তাহের শনিবার রাত ৯টায় এবিসি রেডিওর ক্যারিয়ার কোচ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন তিনি। গত ২৭ জানুয়ারি কথা বলেছেন স্বপ্ন নিয়ে–এর সঙ্গে।
জি এম কামরুল হাসান। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
জি এম কামরুল হাসান। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

পুরকৌশল থেকে প্রাণরসায়ন...
আমার বাবা খুব কড়া মানুষ ছিলেন। সরকারি চাকরি করতেন। সে সময়ের অন্য মা-বাবাদের মতো তিনিও চেয়েছিলেন, ছেলে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হোক। ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিলাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরকৌশলে ভর্তি হওয়ার পর চলে এলাম ঢাকায়। কিন্তু আমার আসলে পুরকৌশলে মন টেকেনি। বাবাকে না জানিয়ে, পুরোপুরি নিজের সিদ্ধান্তে প্রকৌশল ছেড়ে ভর্তি হয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে। বাবা ভীষণ রাগ করেছিলেন। তিন মাস কথা বলেননি। কিন্তু বাবা তো বাবাই, পরে মেনে নিয়েছেন। প্রাণরসায়নে পড়ে সেলসে কাজ করাটাও অনেকটা হুট করেই হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় আমি টিউশনি করতাম, একটা এনজিওতেও কিছুদিন কাজ করেছি। খবর পেলাম, নেস্‌লেতে মেডিকেল প্রতিনিধি হিসেবে লোক নিচ্ছে। যোগ দিয়ে ফেললাম।

সিইও বরাবর চিঠি...
নেস্‌লেতে আমাকে যিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, ১৫ দিন কাজ করার পর হঠাৎ বললেন, কাল থেকে তোমার আর আসতে হবে না। আমি খুব অবাক হলাম। বললাম, ‘কেন? আমি তো অন্যায় কিছু করিনি।’ তিনি বললেন, ‘তোমার কাজ আমাদের মান অনুযায়ী হচ্ছে না।’ খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এর কিছুদিনের মধ্যে আমি নেস্‌লের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ঠিকানা খুঁজে বের করলাম। সুইজারল্যান্ডে তাঁর কাছে একটা রেজিস্টার্ড চিঠি পাঠালাম। লিখলাম—নেস্‌লের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে আমি এমনটা আশা করিনি। মাস ছয়েক পর জানলাম, ঢাকায় নেস্‌লে কর্তৃপক্ষ আমাকে খুঁজছে। ভয়ে ভয়ে গেলাম। তখন মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন একজন শ্রীলঙ্কান। তিনি বললেন, ‘তুমি কি সিইওর কাছে চিঠি লিখেছ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ লিখেছি।’ তিনি আমার সাহসের প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘তুমি কি আবার জয়েন করতে চাও?’ আমি রাজি হয়ে গেলাম। সেই যে যোগ দিলাম, এরপর ১২ বছর কেটেছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

করতে করতে শেখা

বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে মার্কেটিং বা সেলসে কাজ করতে গিয়ে আমি এক রকম সুবিধাই পেয়েছি। সেলসও এক রকম বিজ্ঞান। কাজ করে মজা পেয়েছি বলেই তো মনে হয় ২৫ বছর চোখের পলকে কেটে গেল। আমি মনে করি, একটা কাজ শিখে করা যায়, আবার করতে করতেও শেখা যায়। আমি সব সময় শেখার চেষ্টা করেছি। যখনই কোনো কাজে ভালো করেছি, জানার চেষ্টা করেছি, কেন ভালো হলো। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা খারাপ করার কারণ খুঁজি, ভালোর কারণ খুঁজি না।

তরুণদের জন্য যত সুযোগ

এখন তরুণদের হাতে লিংকডইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গুগল আছে। নেটওয়ার্ক তৈরি করা অনেক সহজ। তবে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে। স্নাতক শেষ করে তরুণেরা উবার চালাচ্ছে, রেস্টুরেন্টে কাজ করছে। আমাদের সময় এই কাজ করলে লোকে বলত, ‘তুমি কী করছ!’ এখন আপনি কী করছেন সেটা বড় নয়। বড় হলো আপনি কিছু করছেন কি না, কাজের মধ্যে আছেন কি না। এখন প্রতিযোগিতা বেশি, সুযোগও বেশি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই নিজের একটা ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তৈরি করতে হবে। আপনাকে দেখলে যেন কোম্পানি মনে করে, এই লোকটাকে ১০ টাকা দিলে আমি ১১ টাকা আয় করতে পারব। সে জন্য শুধু কাজ জানলে চলবে না, আরও কিছু লাগবে। ইতিবাচক মানসিকতা, শরীরী ভাষা, যোগাযোগের দক্ষতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে নিজেকে একজন লিডার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা হলো আমরা গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, কিন্তু দক্ষ মানুষ গড়ছি না। দক্ষতা তাই শিক্ষার্থীদের নিজ দায়িত্বে অর্জন করতে হবে। ছাত্রাবস্থা থেকেই কাজ করো, ক্যাম্পাসের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হও, প্রয়োজনে টিউশনি করো। টিউশনিও কিন্তু একটা বড় শিক্ষা। আপনি যখন কাউকে পড়াচ্ছেন, আপনার যোগাযোগের চর্চা হচ্ছে। ছাত্র আপনার কথা শুনছে না, তখন ধৈর্যের চর্চা হচ্ছে। টিউশনির মাধ্যমেও কিন্তু নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে উঠতে পারে। যদি সহজ করে বলি, আমার পরামর্শ একটাই—সব সময় বিনয়ী আর সৎ হতে হবে।