আমার শিক্ষক আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

প্রফেসর আনিসুজ্জামান আমার ছাত্রজীবনের শিক্ষক, গবেষক-জীবনের শিক্ষক এবং শিক্ষক-জীবনের শিক্ষক। উনিশ শ আশি সালের শেষদিকে 'সওগাত পত্রিকার সাহিত্যিক ভূমিকা ও সামাজিক অবদান' বিষয়ে গবেষণার জন্য আমি কলকাতায় যাই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।

গবেষণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার অবলম্বন ছিলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান। এই পর্বে আমার ব্যক্তিগত সংকট নিরসনে স্যার এবং ভাবি সিদ্দিকা জামানের ভূমিকা ও মমত্ব আমার কাছে চিরস্মরণীয়। তাঁদের কাছে আমার ঋণ অপরিমেয়।

আশি থেকে চুরাশি—এই চার বছর আমার কলকাতা বাসকালে স্যার বহুবার কলকাতা ও কলকাতার বাইরে ভারতের অন্যান্য শহরে গেছেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খুব একটা নয়, প্রায় সবটাই ভারত সরকারের ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে।

একাশিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের (আইসিসিআর) অতিথি হিসেবে কলকাতায় এসেছেন, আমন্ত্রিত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, দুজনেরই থাকবার ব্যবস্থা ছিল পার্কস্ট্রিটের পার্ক হোটেলে। এই সফরে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসে বক্তৃতা দিয়েছেন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় করেছেন। দিল্লীর জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি ও বোম্বে ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন করেছেন, কেরালায় বক্তৃতা দিয়েছেন। কলকাতায় পার্ক হোটেলে আমরা দেখা করি, শুধু আমরাই নই, স্যারের বহু গুণগ্রাহীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ব্যস্ততার ভেতরও সময় বুঝে আমরা আমাদের গবেষণা বিষয়ে পরামর্শ নিই। একটা ভিন্ন পরিবেশে এড়িয়ে না গিয়ে স্যার আন্তরিকতার সঙ্গে পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্যারের এই গুণ সর্বজনবিদিত বলেই তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব।

তিরাশিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের আনুকূল্যে স্যার কলকাতায় এসেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংরক্ষিত পুঁথি থেকে উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এবার তাঁর ঠিকানা ছিল 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশ্যাল সায়েন্সেসের' অতিথি ভবন। আমরা আগে থেকেই ওখানে ছিলাম। গবেষণাকাজের জন্য কলকাতা বাসের বেশ অনেকটা সময় দেশপ্রিয় পার্কের এই অতিথি ভবনে আমরা থেকেছি। আমাদের ঠিক পাশের ঘরটাই স্যারের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। এবারে মাসখানেকের বেশি সময় স্যারের ঘনিষ্ঠ সাহচার্য পেয়েছি, দেশে তাঁর এত কাজের মাঝে, ছাত্রছাত্রী, অনুরাগীদের ভিড়ে এভাবে পাইনি। কাছ থেকে দেখলাম বিদ্বজ্জন মহলে স্যারের সমাদর। প্রায়ই জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাঁর সমঝদার অনেক। একাত্তর সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কালে কলকাতায় অবস্থানের সময় তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সহায়ক সমিতির সম্পাদক ও প্রবাসী সরকারের তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে পরিকল্পনা সেলের সদস্য হিসেবে কাজ করার সময় অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাঁরাও এই সুযোগে স্যারের সঙ্গে মিলিত হন।

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

স্যারের পাণ্ডিত্যের অনুরাগীগণ বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তৃতা দানের আয়োজন করেন। এবার এশিয়াটিক সোসাইটিতে তিনি বক্তৃতা করেন, বিষয়: একাশি সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত 'Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India office library and Records' নামে ইংরেজি গ্রন্থে বিধৃত বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক চিত্রের বিবরণ। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংগৃহীত বাংলায় লেখা চার হাজারের বেশি চিঠিপত্র ও দলিলের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। তারই বিবরণ এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। বক্তৃতায় অষ্টাদশ শতকের শেষ আড়াই দশক থেকে উনিশ শতকের প্রথম দেড় দশক (১৭৭৪-১৮১৪) পর্যন্ত সময়ের সরকারি চিঠি, দলিল-দস্তাবেজের বর্ণনা দিয়েছেন। ফ্যাক্টরি কোরেসপনডেন্স বিষয়ে বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের তাঁতিদের অবস্থান ও এখানকার বস্ত্রশিল্পের অর্থনৈতিক দিকটার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই সব চিঠিপত্রে বিধৃত তথ্যের ভিত্তিতে ইংরেজদের কূটকৌশলে বাংলাদেশের তাঁতিরা কীভাবে বঞ্চিত হতেন, কীভাবে প্রতারণার শিকার হতেন, বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক সুনাম ক্রমশ লোপপ্রাপ্ত হতে শুরু করে—তার বর্ণনা দেন। স্যারের সংগৃহীত চিঠিপত্র ও দলিলের ভাষা যেমন সমকালীন সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরে, তেমনি উনিশ শতকের পূর্বের বাংলা গদ্যের নমুনা হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলা গদ্যের ইতিহাসের পুনর্গঠক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অসাধারণ বক্তৃতাটি শোনেন। তাঁদের কাছে স্যারের মনীষার কদর আরেক ধাপ বেড়ে যায়।

গৌরী আইয়ুবের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় ঘরোয়া আলোচনা সভা বসে। স্যার ছিলেন সেদিনের বক্তা। বাংলাদেশে তখন স্বৈরশাসন চলছে। সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের চিত্র তুলে ধরেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ টিপ পরে স্কুলে উপস্থিত হতে পারবে না—এই বিধানকে উপেক্ষা করে এক শিক্ষিকার চাকরি ছাড়ার কথা বলেন তিনি।

একদিন হন্তদন্ত হয়ে গৌরকিশোর ঘোষ এলেন দেখা করতে। তাঁর 'প্রেম নেই' উপন্যাসটি রচনার সময় স্যারের গবেষণাগ্রন্থ 'মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য' অন্যতম সহায়ক গ্রন্থ ছিল। গৌরকিশোর ঘোষ তখন 'আজকাল' পত্রিকার সম্পাদক। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় জেল খেটেছেন। এই আইনের প্রতিবাদে পুরো সময় মাথা ন্যাড়া করে রেখেছেন। তিনি স্যারকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন, আমরাও নিমন্ত্রিত। নানা গল্পের মধ্যে গৌরকিশোর ঘোষ পরিহাস-ছলে কৌতুক করে বললেন, ম্যাগসেসে পুরস্কার প্রদানের সময় তাঁকে প্রকৃত পরিচয়ে গরু কিশোর ঘোষ নামে ঘোষণা করেছিল। খাবার পরিবেশনের সময় তাঁর বাড়িতে কাজের ছেলেটার পরিচয় করিয়ে বললেন, ও ক্লাস থ্রিতে পড়ে, গল্প লেখে। সঙ্গে সঙ্গে স্যারের মন্তব্য 'এক ঘরমে দো পীর।'

আনিসুজ্জামান স্যারের কলকাতা আগমন উপলক্ষ্যে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হাউজে সান্ধ্যভোজের আয়োজন করেন। স্যারের পুরোনো বন্ধুরাও সেখানে আমন্ত্রিত। নবনীতা দেব সেন, শুদ্ধশীল বসুরা ছাড়াও সুবীর রায় চৌধুরী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের কিউরেটর ও আমরা। খেতে খেতে প্রচুর গল্প হলো, বিষয় নতুন প্রকাশিত দুদেশের সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমা, পাশ্চাত্য সাহিত্য—এ ধরনের আরও অনেক কিছু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জয়ন্ত রায় নিমন্ত্রণ জানালেন স্যারকে, সঙ্গে যথারীতি আমরা নিমন্ত্রিত। দুজন অধ্যাপক একসঙ্গে হলে যা হয়, দুদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সম্পর্কে আলোচনা হয়।

স্যার আরও অনেকের সঙ্গে পরিচিত হলেন। নিরঞ্জন হালদার, ঝরা বসু, প্রদীপ বসু, উৎপল চৌধুরী ও ইলা চৌধুরী। তাঁরা স্যারকে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং সাদর অথ্যর্ভনা জানান। ঝরা বসু তাঁর 'পুরোনো বাংলা গদ্য' বইটি 'দেশ' পত্রিকায় রিভিউ করেন।

স্যারের ঢাকায় ফেরার দিন সকালে গুছিয়ে নিয়ে আমাদের ঘরে এসে বসলেন। একে একে তাঁকে বিদায় জানাতে এলেন ড. বরুণ দে—তখন তিনি সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সেসের পরিচালক, প্রফেসর অনিরুদ্ধ রায়, হিতেশ রঞ্জন সান্যালসহ আরও অনেকে। জোর আড্ডা জমে উঠল। কলকাতার সে সময়ের এসপি নজরুল ইসলাম এলেন, তাঁর গাড়িতে স্যারকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবেন বলে। স্যার সবার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

দেশ ও দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রফেসর আনিসুজ্জামান তাঁর পাণ্ডিত্যের গভীরতায়, উদারনৈতিক চেতনায় এবং মতপ্রকাশের স্পষ্টতায় সারস্বত মহলে সশ্রদ্ধ সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছেন।