বিশ্বকে যাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন নতুন মাত্রায়

টপটক অনুষ্ঠানের দুই অতিথি শামীম মোহাম্মদ ও আসিফ নাইমুর রহমান
টপটক অনুষ্ঠানের দুই অতিথি শামীম মোহাম্মদ ও আসিফ নাইমুর রহমান
সফল মানুষদের গল্প শুনতে, তাঁদের ভাবনা বা পরামর্শগুলো জানতে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে শুরু হয়েছে ‘এমটিবি নিবেদিত টপ টক’ অনুষ্ঠান। ১৩ জুন এর প্রথম অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে যুক্ত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত গাড়ির সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কারম্যাক্সের প্রধান তথ্য ও কারিগরি কর্মকর্তা (সিআইটিও) শামীম মোহাম্মদ। উপস্থিত ছিলেন রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (সিআইও) আসিফ নাইমুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান মুনির হাসান। আলোচনার সংক্ষিপ্ত রূপ থাকল স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য।

মুনির হাসান: শামীম মোহাম্মদ, আপনি সম্প্রতি এমআইটি স্লোন নেতৃত্ব পুরস্কার ২০২০ পেয়েছেন। আর আপনি কারম্যাক্সের সিআইটিও। এই পদের ভূমিকা এবং আপনার পুরস্কার সম্পর্কে একটু সংক্ষেপে বলবেন?

শামীম মোহাম্মদ: সিআইটিওর ভূমিকা হলো যে ব্যক্তি একটা কোম্পানির সব প্রযুক্তিগত তথ্য ব্যবস্থাপনা করেন। আগে কেবল নেটওয়ার্ক, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, নিরাপত্তা—এগুলো ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হতো। এখন যেহেতু বেশির ভাগ কোম্পানি ডিজিটাল পরিবেশে খুবই ক্রিটিক্যাল, তাই সিআইটিওর ভূমিকাও বদলে গেছে গত দশ বছরে। কোনো কোম্পানির শক্তিশালী সিআইও না থাকে, তবে প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিচ্ছে। গত ১৩ বছর হলো তারা প্রতিবছর বিশ্বে একজনকে নির্বাচন করে এই স্লোন সিআইও নেতৃত্ব পুরস্কার দেওয়ার জন্য। ওরা দেখে কোন সিআইও কোম্পানিতে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ করতে পারছে, দেখে কোম্পানির ফলাফল, মার্কেট শেয়ার, প্রবৃদ্ধি। কারম্যাক্সের সিআইও হিসেবে আমাকে এ পুরস্কার দেওয়ায় খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। এর আগে সিঙ্গাপুরের একজন, তার আগে ব্রাজিল, ভারতের একজন পেয়েছেন।

মুনির: আসিফ নাইমুর রহমান, শামীম কাজটি করছেন যুক্তরাষ্ট্রে আর আপনি সে কাজটি করছেন বাংলাদেশে। মিল–অমিল বলা যায়?

আসিফ নাইমুর রহমান: অনেকটাই মিল আছে। গত দশ বা পনেরো বছর প্রযুক্তির যেসব রূপান্তর, বিশেষ করে মানুষ যেগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলো বাড়ছে করপোরেট, বেসরকারি ও সরকারি খাতে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট, সেগুলো অনেক সিস্টেম ব্যবহার করে। সঙ্গে হার্ডওয়্যারও। ডেটাবেজ, সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন—এগুলোর মধ্যে যে সমন্বয় বা ইন্ট্রিগেশন, সেগুলো স্পর্শকাতর। আমি মনে করি, বিশ্ব যেমন নতুন এক মাত্রায় যাচ্ছে, ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশের অবস্থাও একই রকম।

মুনির: আগে যাদের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) বলা হতো, তাদেরই কি এখন আমরা চিফ ইনফরমেশন অফিসার বা সিআইও বলছি?

শামীম: এই দুটি ভূমিকায় কিছুটা পার্থক্য আছে। আগে প্রযুক্তি ছিল অফিসের কাজের সহায়ক। এখন প্রযুক্তি এসেছে সামনে। সিআইও কাজ করত সিটিওর অধীনে। এখন উল্টা হয়েছে। সিটিও কাজ করে সিআইওর অধীনে।

মুনির: সিআইও পুরস্কারে দেখলাম লেখা রয়েছে যে প্রযুক্তির প্রয়োগে উদ্ভাবনী ভূমিকা। তার মানে প্রযুক্তির একটি উদ্ভাবনী ভূমিকা শামীম ব্যবহার করেছেন। সেটা কী?

শামীম: আমাদের ক্ষেত্রে আমরা দুইভাবে ইনোভেশন (উদ্ভাবন) করেছি। একটা হলো গ্রাহকপ্রান্তে, আরেকটা আমাদের কর্মীদের অংশে। বিশ্বজুড়েই প্রতিটি কোম্পানি হুমকির মুখে। কারণ, নতুন ছোট ছোট কোম্পানি আসছে নতুন আইডিয়া নিয়ে। যাতে আমাদের গ্রাহকদের নিয়ে তাদের কাছে তারা পণ্য বিক্রি করতে পারে। এটা বন্ধ করতে আমরা গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা দেখতে থাকলাম। একটা গাড়ি কেনার পর ক্রেতার অভিজ্ঞতা যাতে প্রতিদিন ভালো হয়, আমরা সে চেষ্টা করলাম। অন্যদিক আমাদের ২৭ হাজার কর্মী। তারা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করত, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কাজ করত, সেগুলো আমরা সহজ করে দিলাম, যাতে তারা আমাদের গ্রাহকদের দেখভাল ভালো করে করতে পারে। 

মুনির: শামীম একটু আপনার রূপান্তার নিয়ে আলাপ করতে চাই। গাজীপুরের একটা গ্রামে আপনার জন্ম, তখন সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। আপনি সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছেন ১৯৮৪ সালে। ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর আপনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। একটা বিদ্যুৎবিহীন গ্রাম থেকে এসে আপনি চলে গেলেন কোথায়? সেখানে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই। কীভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার কোম্পানির জন্য নিজেকে তৈরি করলেন?

শামীম: আমার জন্ম হয়েছিল গাজীপুরের পিরুজালি গ্রামে। যখন ঢাকার আরমানিটোলায় ভর্তি হলাম ক্লাস থ্রিতে, তখন একটু স্ট্রাগল করতে হচ্ছিল। থ্রি থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত খুব একটা ভালো ফল করিনি। রোল ছিল ২৫। সপ্তম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় আমি তৃতীয় স্থানে চলে আসি। নবম শ্রেণি পর্যন্ত আমার রোল নম্বর ছিল ৩। আসলে যখন আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলাম এবং কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করলাম, তখন ফল আসতে থাকল। যুক্তরাষ্ট্রে এলাম ১৯৮৭ সালে। কাউকেই চিনতাম না। ইংরেজি ভালো ছিল না। কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে এসেছিলাম অথচ আমি কম্পিউটার কখনো দেখিওনি, ধরিওনি। কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে এসেও অ্যাকাউন্টিং পড়েছি। শুধু ব্যবসা বোঝার জন্য। সেটা ছিল চৌকস এক সিদ্ধান্ত। কারণ, ৩০ বছর আগে কিন্তু কেউ চিন্তা করেনি যে ব্যবসা আর কম্পিউটার বিজ্ঞান একসঙ্গে মিলবে। আমার সফলতার মূলমন্ত্র হলো সব সময় যে কারও চেয়ে বেশি পরিশ্রম করা। আই ওয়ান্ট টু হার্ডওয়ার্ক।

মুনির: আসিফকেও বলতে চাই যে আপনি আপনার পেশা শুরু করার পরেই তো পিএইচডি করতে গেলেন? কেন?

আসিফ: আমার প্রায় ২০ বছরের পেশাজীবনে দুটি স্নাতকোত্তর ও একটি এমবিএ ডিগ্রি নিয়েছি। এরপর আবার ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য যাই। এর মূল কারণ আমি আমার মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখতে চাই। যাতে আমার শেখার ক্ষুধাটা মরে না যায়।

মুনির: তার মানে পড়াশোনা করতে হবে এবং সব সময় একটা চর্চার মধ্যে থাকতে হবে। একটু অন্য আলোচনায় যাই। এই যে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল রূপান্তর হচ্ছে, সেখানেও শামীর কর্মী নিয়োগ করছেন। অর্থাৎ বেশির ভাগ জায়গায় যেখানে চাকরির নিশ্চয়তা থাকছে না, সেখানে ডিজিটাল কোম্পানিগুলো অনেক বেশি নিয়োগ দিচ্ছে।

শামীম: কোভিড–১৯ হিট করার আগেই কিন্তু কারিগরি মেধাসম্পন্ন লোকের কমতি ছিল। কোভিড যখন এল মার্চ মাসে, তখন চাহিদা কিছুটা শ্লথ হয়ে গেল। এখন কয়েক সপ্তাহ যাবৎ চাহিদা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও অনেক কোম্পানি ডিজিটাল ছিল না। সৌভাগ্যবশত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে কাজ করছি। আমাদের জন্য যা হয়েছে, যেই ট্র্যাকে আমরা ছিলাম, সেটাতে গতি বাড়াচ্ছি আমরা। বাংলাদেশে যখন আমি যাই, তখন আমি কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি পরিদর্শন করি। এটা দেখতে যে সেখানে কী ধরনের কাজ হচ্ছে। আমি আসলে ইমপ্রেসড যে রিসোর্স কম থাকাতেও তারা পেছাচ্ছে না। আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তখন মুখস্থবিদ্যা ছিল। আশা করি এখন সেটা পাল্টে গেছে।

মুনির: আমরা এখনো কমবেশি মুখস্থবিদ্যায়ই আছি। তবে পাশাপাশি আমরা যেমন গণিত, বিজ্ঞান, এসবের অলিম্পিয়াড করি, রবি একটা প্রোগ্রাম করে, তাতে অনেক কিছু দেখানোর সুযোগ থাকে।

শামীম: আমার মনে হয় অলিম্পিয়াডের মতো এ রকম সমস্যার সমাধানভিত্তিক শিক্ষাদান করতে হবে। আরেকটা জিনিস আমি বলব, সরকারকে এখানে উদ্যোগ নিতে হবে, যেন শিক্ষায় একটা চমৎকার পরিবর্তন আসে।

মুনির: দুজনের কাছেই জানতে চাই, তরুণদের জন্য আপনাদের পরামর্শ কী?

আসিফ: পড়াশোনা, পরিশ্রম—এগুলো যেমন করতে হবে, তেমন অন্যদের সঙ্গে পরিচয়, যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

শামীম: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেটওয়ার্কিং ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট। কারণ আমরা সব প্রশ্নের উত্তর জানি না। সব বিষয় বুঝি না। অন্য একজন জানেন। আমার নেটওয়ার্ক ভালো থাকলে সেটা কাজে লাগবে।

মুনির: আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ।