ট্রাম্প কেন নাইজেরিয়ায় হামলার নির্দেশ দিলেন, আসলেই কি খ্রিষ্টানদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে

নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজায় একটি গির্জাছবি: রয়টার্স

নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে দেশটির সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে এমন অভিযোগের পর বড়দিনে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির একাধিক স্থানে হামলা চালানোর কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সন্ত্রাসীদের আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে ট্রাম্প এ ধরনের হামলার নির্দেশ দিয়েছেন, এটি তারই সর্বশেষ উদাহরণ। তবে ২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ থেকে বের করে আনার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। এসব হামলা সেটার বিপরীত।

হামলা সম্পর্কে যা জানা গেছে

এক ঘোষণায় হামলার কথা জানান ট্রাম্প। এতে তিনি বলেন, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সন্ত্রাসীদের নিশানা করে এসব হামলা চালানো হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী ‘মূলত নির্দোষ খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নির্মমভাবে হত্যা করছে। এমন মাত্রায় (খ্রিষ্টানদের হত্যার করা হচ্ছে), যা অনেক বছর, এমনকি কয়েক শতাব্দীতেও দেখা যায়নি।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, নাইজেরিয়ার সঙ্গে সমন্বয় করে হামলাগুলো চালানো হয়েছে। এসব হামলার জন্য দেশটির সরকারের অনুমোদন ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে লেখেন, ‘আরও আসছে…।’

নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান এবং কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ তুগার বলেন, ‘চলমান যৌথ অভিযানের অংশ’ হিসেবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সোকোটো রাজ্যে হামলা চালানো হয়েছে।

নাইজেরিয়া কেন ট্রাম্পের নিশানায়

যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীদের কিছু অংশ অনেক বছর ধরে দাবি করে আসছে, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান দলের সিনেটর টেড ক্রুজ নাইজেরিয়ার কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পক্ষে কথা বলেন।

টেড ক্রুজ বলেছিলেন, ‘ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ যারা খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর সহিংসতা চালানোর ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়’, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হোক।

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সামষ্টিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি এবং তা সব সময় অটুট থাকবে… নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান অনুযায়ী সব ধর্মের নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বোলা টিনুবু, প্রেসিডেন্ট, নাইজেরিয়া

বিদেশে খ্রিষ্টানরা ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, এটা ট্রাম্প সমর্থকদের প্রেরণার একটি বড় উৎস। ট্রাম্প মনে করেন, এভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা তাঁর সবচেয়ে উত্সাহী ও সক্রিয় সমর্থকদের অন্যতম। প্রসঙ্গত, এভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টান হলো খ্রিষ্টধর্মের সেই সম্প্রদায়, যারা বাইবেলের শিক্ষাকে কঠোরভাবে মানে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসে গুরুত্ব দেয় এবং ধর্মীয় প্রচার বা মিশনারি কার্যক্রমে সক্রিয়।

চলতি বছর এসব উদ্বেগের বিষয়ে ট্রাম্প কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইউএস ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম অ্যাক্টের আওতায় নাইজেরিয়াকে তিনি ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নাইজেরিয়াকে এ তকমা দেওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতা ও কিছু রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল। তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে লবিং করেছে।

এরপর ট্রাম্প পেন্টাগনকে নাইজেরিয়াতে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান পরিকল্পনা শুরুর নির্দেশ দেন। তখন ট্রাম্প বলেছিলেন, নাইজেরিয়ার সরকার যদি ‘খ্রিষ্টানদের হত্যা’ চলতে দেয়, তাহলে তিনি ‘পূর্ণ সামরিক শক্তি দিয়ে সরাসরি হামলার’ নির্দেশ দিতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই ধর্মীয় নিপীড়ন চলছে

ট্রাম্পের সমালোচনার জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার অতীতে বলেছিল, ‘আমাদের দেশে শুধু খ্রিষ্টানরা নন, অন্যান্য ধর্মের মানুষও চরমপন্থী গোষ্ঠীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব গোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম চালায়।

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দেশটিতে মুসলিম ও খ্রিষ্টান জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান, যথাক্রমে ৫৩ ও ৪৫ শতাংশ। জনসংখ্যার বাকি অংশ আফ্রিকার প্রচলিত ধর্মাবলম্বী।

গত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি দেন। সংবাদপত্রে সেই হুমকির খবর দেখছেন মানুষ। নাইজেরিয়ার লাগোসে
ছবি: রয়টার্স

নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। এসব সহিংসতাকে প্রায় সময় ধর্মীয় নির্যাতন হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, প্রকৃত পরিস্থিতি আরও জটিল। হামলার পেছনে ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য বিষয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে যাযাবর পশুপালক এবং কৃষক সম্প্রদায়ের সংঘাতের কথা বলা যায়। এর মধ্যে পশুপালকদের অধিকাংশ মুসলিম, আর কৃষকদের বেশির ভাগ খ্রিষ্টান। জমি ও পানিকে ঘিরেই তাঁদের মধ্যে মূলত প্রাণঘাতী সংঘাত হয়। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত ভিন্নতার কারণে সংঘাত-পরবর্তী পরিস্থিতি তীব্র হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে পাদরি অপহরণের ঘটনাকে অনেক বিশ্লেষক ধর্মীয় কারণে ঘৃণা নয়, বরং অর্থনৈতিক বলে মনে করেন। কারণ, পাদরিরা প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত (মুক্তিপণের) তহবিল সংগ্রহ করতে পারে।

নাইজেরিয়ার সরকার কি বলেছে

গত বৃহস্পতিবারের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের ওপর নির্যাতনের সম্পর্ক থাকার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হয়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, খ্রিষ্টান, মুসলিম বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই হোক না কেন, যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী সহিংসতাকে নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে।

অতীতে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন সরকার দেশের নিরাপত্তা সংকট নিয়ন্ত্রণে নানা সমস্যায় ভুগেছে। দেশটিতে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন এবং শত শত মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম এবং এর অনুসারী ছোট বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স অন্যতম। তাদের হামলায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বড়দিনের আগের রাতে বোর্নো রাজ্যের একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৫ জন নিহত এবং ৩০ জনের বেশি গুরুতর আহত হন।

নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারী অস্ত্রধারী কিছু অপরাধী গ্যাং খ্রিষ্টান ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ব্যাপক অপহরণ এবং হামলা চালায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তারা ‘ডাকাত’ হিসেবে পরিচিত।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা টিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয় সহনশীলতাহীন দেশ হিসেবে উপস্থাপন করার মধ্যে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। তাঁর ভাষায়, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সামষ্টিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি এবং তা সব সময় অটুট থাকবে…। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান অনুযায়ী সব ধর্মের নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন