শ্রীলঙ্কার সংকটের সত্য–মিথ্যা

দেকাতানা এলাকায় জমিতে কাজ করছেন শ্রীলঙ্কার এক কৃষক
ছবি: রয়টার্স

চরম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। গোতাবায়া রাজাপক্ষে পালানোর পর প্রেসিডেন্ট পদ শূন্য। পার্লামেন্ট ঘিরে বিক্ষোভ। দেশটির এ সংকটের কারণ নিয়ে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। দাবি করা হয়েছে, সবুজায়ন ও পরিবেশ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এমন সংকটের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে এসবের সত্যতা কতটুকু? বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।

ক্রমাগত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি অনেক শ্রীলঙ্কাবাসীর জীবন কঠিন করে তুলেছে। কয়েক মাস ধরেই এসব নিয়ে বিক্ষোভ চলেছে। তবে এ সপ্তাহে বিক্ষোভকারীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে হামলা চালান। বিক্ষোভ এমন চরম পর্যায়ে যাওয়ার জন্য কয়েক শ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয়বাদীরা দেশটির সবুজনীতিকে দায়ী করছেন।

একজন টুইটে বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কা জেগে উঠে, ভেঙে পড়েছিল। দেশটির সবুজনীতি একসময়ের সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’

অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী বলছেন, পরিবেশ নিয়ে শাসকশ্রেণির অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে সৃষ্ট রোষ থেকে এই বিক্ষোভ হয়েছে।

টেলিগ্রামের একটি পোস্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা বিশ্ববাদী শক্তি দ্বারা পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সবুজ নীতিকে দায়ী করে একজনের টুইটের স্ক্রিনশট

শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য সবুজনীতিকে দায়ী করার বিষয়টি বুঝতে একটু পেছন দিকে ফেরা যাক। শ্রীলঙ্কা গত বছরের এপ্রিল মাসে রাসায়নিক সারের আমদানি, কীটনাশক ও আগাছা রোধী ওষুধের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে এগুলোকে বিক্ষোভের কারণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন।

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে কোনো দেশই এভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রোগ্রামের সহকারী ফেলো চারু লতা হগ বলেন, ‘এটি অপ্রীতিকর ও অদ্ভুত পদ্ধতি।’

আরও পড়ুন

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের শিক্ষক ড. থিরুনি কালেগামা বলেন, ‘রাজাপক্ষে রাতারাতি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ বিষয়ে কৃষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য তাঁদের পর্যাপ্ত সময় বা রসদ সরবরাহের বিষয়টি নিয়েও ভাবা হয়নি।’

হুট করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে শস্যের ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। প্রধান প্রধান খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রক্রিয়া চালুর সাত মাসের মধ্যে সরকার এই নীতি থেকে সরে আসে।

জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার সরকার ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বিক্ষোভকারীদের হামলার পেছনে অনেকেই শ্রীলঙ্কার পুরোনো এসব নীতিকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল ধারার কিছু গণমাধ্যমে এই অভিযোগ বেশি তোলা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয়বাদীরাও শ্রীলঙ্কার চলমান বিক্ষোভের জন্য এসব কারণকে দায়ী করেছেন।

ফক্স নিউজের উপস্থাপক টাকার কার্লসনকে এক অনুষ্ঠানে বলতে দেখা গেছে, শ্রীলঙ্কার সংকট ও ধসের জন্য জলবায়ুবান্ধব নীতি অন্যতম কারণ।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে কী

কয়েক দশকের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর এই অর্থনৈতিক সংকট থেকেই রাজনৈতিক সংকটের শুরু। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি কারণ। তবে এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের শিক্ষক ড. থিরুনি কালেগামা বলছেন, শ্রীলঙ্কার এত বড় অর্থনৈতিক সংকটের জন্য জৈবপদ্ধতির চাষাবাদকে দায়ী করা হলে সেটিকে খুব ছোট করে দেখা হবে। এই অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের দীর্ঘদিনের খারাপ অর্থনৈতিক নীতি দায়ী।

ফেসবুক পোস্টে শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য সবুজ নীতিকে দায়ী করেছেন একজন

এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের কারণ হিসেবে দেশটির সরকার পর্যটকদের সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। করোনা মহামারির কারণে পর্যটননির্ভর শ্রীলঙ্কা অনেকটাই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। আমদানির জন্য এই বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

তবে শ্রীলঙ্কার এই সংকট নতুন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের বদলে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহের দিকে মন দেয়। রপ্তানি থেকে দেশটির আয় কমে যায়। তবে আমদানির ব্যয় বাড়তেই থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় জ্বালানি ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য অর্থ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

অনেক বেশি হারে কর কমানো, ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ, বড় বড় অবকাঠামোর জন্য খরচের কারণেও দেশটির অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। আর এই অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে। ফলে জনরোষের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কার সরকার। আর তার ধারাবাহিকতাতেই বেড়েছে রাজনৈতিক সংকট।