নেপালে যেসব কারণে বিক্ষোভ হচ্ছে

পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া টুপি পরছেন এক বিক্ষোভকারী। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স

নেপালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। তাঁর আগে একাধিক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। গতকাল সোমবার বিক্ষোভকারীরা কে পি শর্মার ব্যক্তিগত বাসভবন ও প্রেসিডেন্ট ভবনসহ অনেক মন্ত্রীর বাসভবন ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় আগুন দিয়েছেন।

গতকাল রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত হিমালয়–কন্যাখ্যাত দেশটির বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ১৯ জন নিহত ও কয়েক শ আহত হন। আজ নিহত হন আরও অন্তত দুজন। গতকাল থেকে কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। নামানো হয়েছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু জনগণ এসব উপেক্ষা করেই গতকাল রাস্তায় নেমে আসেন।

অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানোসহ নানা অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে কোম্পানিগুলোকে নেপালের আইন মেনে নিবন্ধন করার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু টিকটক, ভাইবারসহ আরও পাঁচটি অ্যাপ নিবন্ধন করায় সেগুলো ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা লিংকডইনের মতো অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্মগুলোয় প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত নেপালি তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম বন্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দেশটিতে ‘নেপো কিডস’ ও ‘নেপো বেবিস’ হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে গতকাল রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

তাই বৃহস্পতিবার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করাই গতকাল শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মূল কারণ নয়; বরং এটা একটি উপলক্ষ মাত্র। অনুঘটক হিসেবে অন্যান্য বিষয় কাজ করেছে।

আরও পড়ুন

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলনে দেশটির নানা ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব, সুযোগ–সুবিধায় বৈষম্য ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, তরুণদের একটি অংশ পুরোনো নেতৃত্বকে মানতে পারছিল না। তাই বিক্ষোভ অল্প সময়ে এতটা তুঙ্গে উঠেছে।

ইউরেশিয়া রিভিউর এক বিশ্লেষণে বলা হয়, শুধু ২০২৫ সালেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ–বিষয়ক মন্ত্রী ঘুষের অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন।

বিমানবন্দর নির্মাণে জালিয়াতি, নেপাল টেলিকমে অর্থ আত্মসাৎ, অভিবাসন দপ্তরে চাঁদাবাজি—এসব কেলেঙ্কারিতে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। সোনা চোরাচালান ও শরণার্থী প্রতারণা কেলেঙ্কারিতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখেছেন, বড় নেতাদের আসলে কোনো সাজা হয় না। সেখানে দেখা যায়, তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়, নিচুতলার কর্মীরা শাস্তি পান অথচ ক্ষমতাবানরা বেঁচে যান।

আরও পড়ুন

বৃহস্পতিবারের আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পোশাক–গয়না প্রদর্শনের ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাঁদের ব্যঙ্গ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ‘নেপো কিডস’ বা ‘নেপো বেবিস’ ও ‘পলিটিশিয়ানসনেপোবেবিনেপাল’ জনপ্রিয় হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি তীব্র তুলনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে—‘তাঁদের সন্তানেরা গুচির ব্যাগ নিয়ে ফেরে, আমাদের সন্তানেরা কফিনে ফেরে।’

এর মাধ্যমে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। তা হলো, নেতাদের সন্তানেরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরে দামি পণ্যের ঝাঁপি নিয়ে, আর সাধারণ পরিবারের সন্তানেরা অসুরক্ষিত প্রবাসী শ্রমের শিকার হয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে কফিনে লাশ হয়ে ফেরে।

এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি জনআস্থাকে ভেঙে চুরমার করেছে। অর্থনীতি তীব্র ধাক্কা খেয়েছে। নেপালিরা কর দেন, কিন্তু এর বিনিময়ে সড়ক, হাসপাতাল ও স্কুলের উন্নতি পান না। মন্ত্রীরা কেবল নিজেদের পকেট ভারী করেন।

আরও পড়ুন

তা ছাড়া এক বছরের বেশি সময় ধরে নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। সরকারের অভিযোগ ছিল, দেশে সাইবার অপরাধ, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট (আধেয়) বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

এ অবস্থায় গত মাসে নেপালের শীর্ষ আদালত একটি রায় দেন। এতে বলা হয়, সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দেশের আইন মেনে নিবন্ধনে বাধ্য করতে পারে। কোম্পানিগুলোর এক স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া দরকার, যাঁর কাছে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সরকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অভিযোগ জানাতে পারবে।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নিয়ম মেনে টিকটক, ভাইবার, উইটক, নিম্বাজ ও পপ্পো লাইভ নিবন্ধন করে। সেগুলো সচল আছে। তবে ২০২৩ সালে দেশটিতে টিকটক বন্ধ করা হয়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের পক্ষে সরকারের আরেকটি বক্তব্য ছিল, বিদেশি কোম্পানিগুলো কোনো নিয়মের মধ্যে না থাকায় দেশ থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো কর দিচ্ছে না। কোম্পানিগুলো নিবন্ধ করলে দেশের বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে। গত রোববার কে পি শর্মা অলি এই কথা পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।

তবে সমালোচকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। সরকার অনলাইনে নজরদারি বাড়ানোর জন্যই এটা করেছে। তাঁদের আরও অভিযোগ ছিল, পর্যটননির্ভর নেপালের মানুষ ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চল ও বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের যোগাযোগের ভরসার বড় জায়গা এসব প্ল্যাটফর্ম।