চীন-তাইওয়ান বৈরিতার শুরু যেখান থেকে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। এর জেরে তাইওয়ান ঘিরে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। এমনকি মহড়ার অংশ হিসেবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া হয়েছে।  

তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে মনে করে চীন। তাই এর নিয়ন্ত্রণ নিতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ভাষ্যমতে, চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের ‘একত্রকরণ’ অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে। এমনকি লক্ষ্য পূরণে সামরিক শক্তি খাটানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি তিনি।

অপর দিকে তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে। তাদের নিজস্ব সংবিধান ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা রয়েছে। তাইওয়ানের বেশির ভাগ বাসিন্দাও নিজেদের তাইওয়ানি হিসেবে পরিচয় দেন।

চীন ও তাইওয়ানের এই দ্বন্দ্বের শুরুটা কবে, সামরিক সক্ষমতায় কে এগিয়ে, আর চলমান সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

তাইওয়ানের অবস্থান কোথায়

তাইওয়ান একটি দ্বীপ। চীনের দক্ষিণ–পূর্ব উপকূল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০০ মাইল। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রদেশও রয়েছে। এই দেশগুলোকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।

পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, চীন যদি তাইওয়ান দখল করে নেয়, তাহলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশটির শক্তি আরও বেড়ে যাবে। এমনকি গুয়াম ও হাওয়াই দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তবে এ নিয়ে ভিন্নমত চীনের। দেশটি বলছে, তাইওয়ান নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই শান্তিপূর্ণ।

তাইওয়ান কি সব সময় চীন থেকে আলাদা ছিল

ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র বলছে, ১৭ শতকে প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ পায় চীন। তখন চীনে শাসন করছিল কুইং রাজপরিবার। পরে প্রথম চীন–জাপান যুদ্ধে হেরে ১৮৯৫ সালে দ্বীপটি জাপানের কাছে ছেড়ে দেয় চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজয় স্বীকারের পর আবার তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ পায় বেইজিং।

এরপর চীনের মূল ভূখণ্ডে চিয়ান কাই–শেক নেতৃত্বাধীন দেশটির জাতীয়তাবাদী সরকার ও মাও সে–তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ওই যুদ্ধে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টদের জয় হয়। এর মধ্য দিয়ে বেইজিং চলে যায় তাদের হাতে।
কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পরাজিত হওয়ার পর চিয়াং কাই–শেক ও তাঁর জাতীয়তাবাদী দল ‘কুয়োমিনটাং’–এর অনেকে তাইওয়ানে পালিয়ে যান। এর পরের কয়েকটা দশক সেখানেই তাঁরা শাসন করেছিলেন। ওই সময় থেকেই কুয়োমিনটাং দ্বীপটির সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল।

পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, যদি সত্যিই যুদ্ধ বাধে, তাহলে তাইওয়ান বড়জোর চীনের হামলার গতি কমানোর দিকে নজর দিতে পারবে। তাইওয়ানের সমুদ্রসৈকতে চীনা বাহিনীর অবতরণ ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে তাইওয়ান বাহিনী। আর বাইরে থেকে সাহায্য না আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারে গেরিলা হামলা।

মূলত ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেই চীন দাবি করে আসছে, তাইওয়ান তাদের একটি প্রদেশ। ইতিহাসের কথা টেনেই আবার উল্টো দাবি করছে তাইওয়ান। তাদের ভাষ্য, ১৯১১ সালের বিপ্লবের পর যে আধুনিক চীন গড়ে উঠেছিল, কোনোকালেই তার অংশ ছিল না তাইওয়ান। এমনকি ১৯৪৯ সালে মাও সে–তুংয়ের হাত ধরে গড়ে ওঠা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধীনেও ছিল না তারা।

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যাও কম। বিভিন্ন দেশকে এ নিয়ে কূটনৈতিক চাপের মধ্যে রেখেছে বেইজিং। মাত্র ১৩টি দেশের কাছ থেকে তাইওয়ান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

তাইওয়ান কি নিজেদের রক্ষা করতে পারবে

তাইওয়ানকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে সামরিক পথে না–ও হাঁটতে পারে চীন। নিতে পারে দ্বীপটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মতো পদক্ষেপ। তবে চীন যদি সামরিক শক্তি প্রয়োগের দিকে এগোয়, তাহলে সংকটে পড়তে পারে তাইওয়ান। কারণ, তাইওয়ানের চেয়ে সামরিক শক্তিতে বহু এগিয়ে চীন।

বিশ্বে সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই রয়েছে চীন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, এমনকি সাইবার হামলার দিক দিয়েও ব্যাপক সক্ষমতা রয়েছে দেশটির।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি স্টাডিজ চীন ও তাইওয়ানের সামরিক শক্তির একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও রিজার্ভ বাহিনী মিলে চীনের মোট সৈন্য সংখ্যা ২০ লাখ ৩৫ হাজার। অপর দিকে তাইওয়ানের ১ লাখ ৬৯ হাজার।

আরও পড়ুন

এর বাইরে অন্যান্য সমরাস্ত্রের হিসাব করলে, চীনের হাতে এই মুহূর্তে ৫ হাজার ৪০০টি ট্যাংক রয়েছে। তাইওয়ানের ট্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৬৫০। চীনের যেখানে ৩ হাজার ২২৭টির বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে, সেখানে তাইওয়ানের যুদ্ধবিমান ৫০৪টির কিছু বেশি।
চীনের সাবমেরিনের বিশাল বহর রয়েছে। দেশটির মোট সাবমেরিনের সংখ্যা ৫৯। অপর দিকে তাইওয়ানের হাতে মাত্র চারটি সাবমেরিন রয়েছে। চীন ও তাইওয়ানের নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা যথাক্রমে ৮৬ ও ২৬। আর চীনের ৯ হাজার ৮৩৪টির বেশি কামানের বিপরীতে তাইওয়ানের রয়েছে ২ হাজার ৯৩টি।

গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াবে কি না। জবাবে বাইডেন বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ’।

পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, যদি সত্যিই যুদ্ধ বাধে, তাহলে তাইওয়ান বড়জোর চীনের হামলার গতি কমানোর দিকে নজর দিতে পারবে। তাইওয়ানের সমুদ্রসৈকতে চীনা সেনাদের অবতরণ ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারে তাইওয়ান বাহিনী। আর বাইরে থেকে সাহায্য না আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারে গেরিলা হামলা।

যুদ্ধ শুরু হলে তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আগে থেকেই দ্বীপটির কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি করে আসছেন মার্কিনরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াবে কি না। জবাবে বাইডেন বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ’।

আরও পড়ুন

পরিস্থিতি কি আরও খারাপ হচ্ছে

তাইওয়ানে ন্যান্সি পেলোসির সফরের মধ্য দিয়ে চীন–তাইওয়ান সম্পর্ক আরও তিক্ততার দিকে গেছে। বেইজিং পেলোসির এই সফরকে ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ আখ্যা দিয়েছে। চীন বলছে, তাদের সামরিক মহড়া তাইওয়ানের চারপাশে ঘিরে থাকা ছয়টি বিপজ্জনক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চলছে। এর মধ্যে তিনটি অঞ্চল তাইওয়ানের জলসীমার ভেতরে পড়েছে।

তাইওয়ানের অভিযোগ, চীনের এই পদক্ষেপ তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, এটি অবরোধের সমান। ভবিষ্যতে ব্যাপক সাইবার হামলার আশঙ্কাও করছে তাইওয়ান। এ নিয়ে নিজ ভূখণ্ডে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করেছে দ্বীপটির সরকার। বলতে গেলে, সবকিছু মিলিয়ে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে।
২০২১ সালেও চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছিল। সে বছর তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা সীমানায় একাধিকবার চীনা যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করেছিল অক্টোবরে। তখন তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ৪০ বছরের মধ্যে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন

বিশ্বে তাইওয়ান কেন গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্বে তাইওয়ানের অর্থনীতির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। মুঠোফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, ঘড়ি ও গেম কনসোলের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতে কম্পিউটার চিপ ব্যবহার করা হয়। এই চিপের বড় একটি অংশ তৈরি হয় তাইওয়ানে।

চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে তাইওয়ানে অনেকেরই কোনো মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। গত অক্টোবরে একটি জরিপে তাইওয়ানের বাসিন্দাদের কাছে প্রশ্ন করা হয়, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা আছে বলে তাঁরা মনে করেন কি না? ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষই জবাব দেন, তাঁরা এমন কিছুর আশঙ্কা করছেন না।

তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি বিশ্বে কম্পিউটার চিপের বাজারের অর্ধেকের বেশি দখল করে রেখেছে। ২০২১ সালে এই প্রতিষ্ঠানের অর্থমূল্য ছিল প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার।

তাই তাইওয়ানের দখল যদি চীনের হাতে যায়, তাহলে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যাবে বেইজিং।

তাইওয়ানের বাসিন্দারা কি উদ্বিগ্ন

চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে তাইওয়ানের অনেকেরই কোনো মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। গত বছরের অক্টোবরে একটি জরিপ চালিয়েছিল তাইওয়ান পাবলিক অপিনিয়ন ফাউন্ডেশন। সেখানে তাইওয়ানের বাসিন্দাদের প্রশ্ন করা হয়, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা আছে বলে তাঁরা মনে করেন কি না? ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষই জবাব দেন, তাঁরা এমন কিছু আশঙ্কা করছেন না।

আলাদা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানি হিসেবে পরিচয় দেন। এ নিয়ে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে একটি জরিপ চালিয়ে আসছে তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটি। জরিপে দেখা গেছে, তাইওয়ানের বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের চীনা ও তাইওয়ানি, দুটোই কিংবা শুধু চীনা হিসেবে পরিচয় দেন তাঁদের সংখ্যা কমেছে।