সিন্ধুর পানিপ্রবাহ বন্ধ নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কি সংঘাত অনিবার্য

পাকিস্তান অংশে সিন্ধু নদের জেগে ওঠা চরে হাঁটছেন মানুষ। ১৫ মার্চ, জমশোরোছবি: রয়টার্স

উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টো প্রায় সাত দশক আগে একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘ইয়াজিদ’ নামের সেই গল্পটি পাকিস্তানের পাঞ্জাবের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত। গল্পের পটভূমিতে গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। মানুষজন বলাবলি করতে থাকেন, ভারত নাকি পাকিস্তানে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বন্ধ করে দেবে।

গল্পের একটি চরিত্র সেই গুজবের জবাবে বলেন, ‘নদী কি কেউ বন্ধ করতে পারে? এটা তো নর্দমা না, নদী।’ ৭৪ বছর পর গল্পের সেই গুজব আজ যেন বাস্তব এক পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।

গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন মানুষ নিহত হন, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এই হামলার জন্য নয়াদিল্লি সরাসরি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। পরের দিন সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত।

নদীর প্রবাহ থেমে গেলে ভাটির দেশ হিসেবে পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

চুক্তিটি ছয় দশক ধরে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ২৭ কোটির বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা এই চুক্তির ওপর নির্ভরশীল, যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানে নাগরিক।

ভারতের ঘোষণার পরদিনই পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটি (এনএসসি) এই একতরফা সিদ্ধান্তকে ‘আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন’ বলে নাকচ করে দেয়। পরিষদ জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানের পানির গতিপথ বদলানো হলে তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে।

পেহেলগামে হামলার ১৫ দিন পর ৭ মে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাল্টা হামলা চালায়। দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। চার দিনের সংঘাতের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়।

সাময়িকভাবে পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ হলেও দুই দেশই কূটনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থানকে বৈশ্বিকভাবে শক্তিশালী করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত নিয়ে এখনো নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে ভারত। গত ২১ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটি আর কখনো পুনর্বহাল হবে না। আন্তর্জাতিক চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করা না গেলেও আমরা তা স্থগিত রাখার অধিকার রাখি এবং আমরা সেটাই করেছি।’

পাকিস্তানের পানির গতিপথ বদলানো হলে, তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি

অমিত শাহ আরও বলেন, ‘চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা আছে, এটি দুই দেশের শান্তি ও উন্নতির জন্য। কিন্তু যখন সে শান্তি ভঙ্গ হয়, তখন চুক্তি রক্ষা করার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত থাকলে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে তা পাকিস্তানের জন্য অস্তিত্বসংকটের প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিতে পারে।

নদীর প্রবাহ থেমে গেলে পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারত পুরোপুরি সিন্ধু অববাহিকার পানি বন্ধ করতে পারবে না। অন্তত বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে ভারতের পক্ষে তা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, শীত মৌসুমে ভারতের সামান্য পানি সরানো বা বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও পাকিস্তানকে গুরুতর বিপদে ফেলতে পারে। কারণ, পাকিস্তানে পানি ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত জলাধার নেই। ফলে ভারত যদি নদীর গতিপথে হস্তক্ষেপ করে, সেই সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি এখনো পাকিস্তানের নেই।

একটি নদী, একটি অঞ্চল, এক বিরোধ

সিন্ধু নদের উৎপত্তির তিব্বতের কৈলাস পর্বতে, যা প্রায় ৫ হাজার ৪৯০ মিটার (১৮ হাজার ফুট) উচ্চতা থেকে নেমে এসেছে। এটি বিশ্বের দ্বাদশ দীর্ঘতম নদ। উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি ভারতের কাশ্মীর অঞ্চল অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আরব সাগরে গিয়ে মিলিত হয়।

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পাহাড়ি পথে সিন্ধু নদ সোয়াট ও কাবুলের মতো পশ্চিম দিকের উপনদীগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর তা পাঞ্জাবের উর্বর সমভূমিতে প্রবেশ করে। যেখানে পূর্ব দিকের ঝিলম, চেনাব, রবি, বিপাশা ও শতদ্রু—এই পাঁচ উপনদী সিন্ধুর সঙ্গে মেশে।

চেনাব নদীর ওপর ভারতের নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘বাগলিহার হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর একটি দৃশ্য। কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি একতরফা স্থগিত করেছে ভারত
ছবি: এএনআই

এসব উপনদী ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। এই ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভারত উজানের দেশ, পাকিস্তান ভাটির দেশ। এ অবস্থানই দুই দেশের মধ্যেকার অবিশ্বাস ও শঙ্কার অন্যতম প্রধান কারণ।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেবল ভারত-পাকিস্তান নয়, বহু দেশের মধ্যেই অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। দজলা ও ফোরাতের পানির ভাগাভাগি নিয়ে গত ৫০ বছর ধরে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের বিরোধ চলেছে।

নীল নদে বাঁধ নির্মাণ ঘিরে ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি মিসর ও সুদানের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। কারণ, ইথিওপিয়া উজানের দেশ এবং বাকি দুই দেশ ভাটির।

দক্ষিণ এশিয়াতেও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পানিবণ্টন নিয়ে মতবিরোধ চলছে।

এটি আর কখনো পুনর্বহাল হবে না। আন্তর্জাতিক চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করা না গেলেও আমরা তা স্থগিত রাখার অধিকার রাখি এবং আমরা সেটাই করেছি
অমিত শাহ, ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

দেশভাগের রেশ

ভারত-পাকিস্তানের পানিবণ্টন–সংক্রান্ত বিরোধের শিকড় ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দেশ ভাগের পর কাশ্মীর দুই প্রতিবেশীর দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। কারণ, সেখান থেকেই ঝিলম ও চেনাব নদীর উৎপত্তি।

ব্রিটিশ আমলে পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থা ছিল অভিন্ন। দেশ ভাগের পর এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ১৯৪৮ সালের মার্চে ভারত ঝিলম ও চেনাব নদী থেকে পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাঁচ সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের প্রায় ৮ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি পানিশূন্য হয়ে পড়ে।

এই সংকটই ছিল মান্টোর ‘ইয়াজিদ’ গল্পের প্রেরণা। আর এই সংকটই পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তির পথ দেখায়। প্রায় ৯ বছর আলোচনার পর ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

লন্ডনের কিংস কলেজের ভূগোলবিদ অধ্যাপক মাজেদ আখতার সিন্ধু পানি চুক্তিকে ‘হাইড্রোলিক পার্টিশন’ বা জলবিভাজন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ, উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের পর পানিব্যবস্থাও বিভক্ত হয়েছিল।

পানিবণ্টনের এই বিরোধ কাশ্মীরের সঙ্গে সরাসরি জড়িত উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, কাশ্মীর যার দখলে, সিন্ধু অববাহিকার পানির প্রবাহের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। কৃষিনির্ভর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য সিন্ধু অববাহিকার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দেশ ভাগের পর থেকে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে চারটি যুদ্ধ হয়েছে, যার তিনটিই হয়েছে কাশ্মীর নিয়ে। সর্বশেষ মে মাসের চার দিনের পাল্টাপাল্টি হামলাও হয়েছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।

ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মারমুখী অবস্থান সত্ত্বেও কিছু বিশ্লেষক ও পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ মনে করেন, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে চলমান অচলাবস্থার সমাধান সম্ভব।  

নদী বিভাজনের চুক্তি

সিন্ধু পানি চুক্তির (আইডব্লিউটি) ৮৫ পৃষ্ঠার বিবরণে সব শর্ত বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক পানিবণ্টন চুক্তির থেকে এটা কিছুটা ব্যতিক্রম। সাধারণ অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি হয় পানির পরিমাণ অনুযায়ী। কিন্তু আইডব্লিউটি হয়েছে নদী ভাগ করার মধ্য দিয়ে।

চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী—রবি, বিপাশা ও শতদ্রু সম্পূর্ণভাবে ভারতের জন্য বরাদ্দ। আর পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী-সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব পাকিস্তানের একচ্ছত্র ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত।

তবে ভারতকে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর ওপর পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণ বজায় রেখে সীমিত ‘রান-অব-দ্য-রিভার’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রান-অব-দ্য-রিভার বলতে বোঝায় এমন একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা নদীর জলপ্রবাহের মূলধারাকে সম্পূর্ণভাবে বাধা দেয় না। এর মাধ্যমে নদীর পানি ছোট ছোট ড্যামে বা বাঁধ দিয়ে সাময়িকভাবে ধরে রাখা হয়। কিন্তু বড় কোনো জলাধার তৈরি করা হয় না। ফলে নদীর পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয় এবং প্রকল্প থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

ভারতের অমৃতসরের কাছে আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত ক্রসিং-সংলগ্ন পাকিস্তান রেঞ্জার্সের একটি চৌকিতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। ২৬ এপ্রিল ২০২৫
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চুক্তিতে তিন স্তরে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তা হলো প্রথমে বিষয়টি স্থায়ী সিন্ধু কমিশনে উঠবে, যা দুই দেশের একজন করে কমিশনার নিয়ে গঠিত। তাতে সমাধান না হলে তা বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে। কোনো বিরোধ এই দুইভাবে সমাধান করা না গেলে, তা হেগভিত্তিক স্থায়ী সালিস আদালতে (পিসিএ) যাওয়ার কথা রয়েছে। পিসিএ জাতিসংঘের অংশ না হলেও একটি আন্তসরকারি সংস্থা।

সিন্ধু পানি চুক্তির ৬৫ বছরের ইতিহাসে মাত্র তিনবার ওপরের প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। তৃতীয় ও সর্বশেষটিতে হয়নি। সব বিরোধই হয়েছিল ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে। প্রথমটি বাগলিহারে (চেনাব)। ২০০৭ সালের এই বিরোধে ভারত নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে বিজয়ী হয়। দ্বিতীয়টি ঝিলম। এতে ২০১৩ সালে পাকিস্তানের আপত্তির রায় দেয় পিসিএ। এতে বলা হয়, ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদনে পানি ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু পাকিস্তানের প্রবাহ বজায় রাখতে হবে।

তৃতীয় ও সর্বশেষ বিরোধ হয়েছে চেনাব নদীতে ভারতের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে। এই প্রকল্প নিয়ে পাকিস্তান পিসিএতে আপত্তি জানিয়েছে। ভারত বলেছে, পিসিএর আগে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ভারত তো চুক্তিই স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। তাই চেনাবের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধের সালিস প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

‘রক্ত ও পানি’

একাধিক যুদ্ধ, সংঘাত, সন্ত্রাসী হামলা ও পারমাণবিক উত্তেজনা সত্ত্বেও সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৬৫ বছর ধরে কার্যকর ছিল। ২০১৬ সালে কাশ্মীরের উরিতে ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৮ সেনা নিহত হয়। এ জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্রগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করে নয়াদিল্লি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘রক্ত ও পানি একসঙ্গে বইতে পারে না।’ এর পর থেকেই মূলত সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের দাবি জোরদার হয়।

এই পরিস্থিতিতে পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে হাজির হয়। অনেক আগে থেকেই তিলে তিলে যার পটভূমি তৈরি হয়েছিল।

ব্রিটিশ আমলে পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থা ছিল অভিন্ন। দেশ ভাগের পর এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ১৯৪৮ সালের মার্চে ভারত ঝিলম ও চেনাব নদী থেকে পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাঁচ সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের প্রায় ৮ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি পানিশূন্য হয়ে পড়ে।

চুক্তি থেকে ভারতের বের হয়ে যাওয়ার পর এপ্রিলে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সিন্ধু প্রদেশে এক সমাবেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সিন্ধু নদ আমাদের, তা আমাদেরই থাকবে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো আমাদের পানি প্রবাহিত হবে, অন্যথায় তাদের রক্ত বইবে।’

আরও পড়ুন

নতুন পানি চুক্তির সম্ভাবনা

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের বর্তমান অবস্থান বেশ কঠোর বলে মনে হচ্ছে। নয়াদিল্লি চুক্তির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেছে। চুক্তি স্থগিত করাকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে অভিহিত করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মারমুখো অবস্থান সত্ত্বেও কিছু বিশ্লেষক ও পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ মনে করেন, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে চলমান অচলাবস্থার সমাধান সম্ভব।

পাকিস্তানের পরিবেশ ও জলবায়ু চ্যালেঞ্জ-বিষয়ক সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মালিক আমিন আসলাম বলেন, ‘আশা করি, ভারত দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের মতো কাজ করবে এবং শেষ পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী সমস্যাগুলো আলোচনা করে সমাধান করতে পারবে।’

ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে পাকিস্তান কী পরিকল্পনা করছে, তা জানতে দেশটির প্রতিরক্ষা, তথ্য ও পানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আল–জাজিরা। কিন্তু এসব বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তান এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনি পথে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

২০১৬ সাল থেকে পাকিস্তান দ্য হেগে অবস্থিত স্থায়ী সালিস আদালতে (পিসিএ) ভারতের ঝিলম ও চেনাব নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। গত সপ্তাহে পিসিএ এক রুলিংয়ে বলেছেন, ভারত আইডব্লিউটি স্থগিত করলেও তাতে করে আদালতের বিচারিক ক্ষমতা ব্যাহত হয় না।

কিন্তু এই মামলায় ভারত পিসিএর বিচার মানতে শুরু থেকেই অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তাই এ আদালত থেকে কোনো রায় এলে ভারত কতটা মেনে নেবে, তা অনিশ্চিত।

কাশ্মীর যার দখলে, সিন্ধু অববাহিকার পানির প্রবাহের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। কৃষিনির্ভর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য সিন্ধু অববাহিকার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
অধ্যাপক মাজেদ আখতার, লন্ডনের কিংস কলেজের ভূগোলবিদ

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সামনে দুটি বিকল্পই কেবল খোলা আছে বলে মনে করেন অনেকে। এক. সামরিক হস্তক্ষেপ। দুই. কূটনীতিক প্রচেষ্টা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উল্লিখিত সামরিক কর্মকর্তা বলেন, সিন্ধুর অববাহিকার পানির সঙ্গে পাকিস্তানের ২৫ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত। আমরা ভারতের পদক্ষেপকে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করছি। তাদের কোনো পদক্ষেপ যদি আমাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে হয়, তাহলে আমরা যথাযথ পাল্টা পদক্ষেপ নেব।

ভারতের ন্যাশনাল ম্যারিটাইম ফাউন্ডেশনের গবেষণা সহযোগী অনুত্তমা ব্যানার্জি মনে করেন, সাম্প্রতিক সংঘর্ষ এরই মধ্যে সংলাপের পরিসর সংকুচিত করে ফেলেছে। তাই এ অবস্থায় কোনো সামরিক পদক্ষেপ হবে অবিবেচনাপ্রসূত।

আরও পড়ুন

ওয়াশিংটনভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের সাবেক ফেলো ব্যানার্জি বলেন, পাকিস্তানেরও এই চুক্তি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করা উচিত। কীভাবে নবায়ন করলে তা থেকে নিজেদের লাভ হবে, তা নিয়ে পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে দুই পক্ষকেই পারস্পরিক লাভের কথা বিবেচনা করে নতুন করে চুক্তির কথা ভাবতে হবে।

যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক দানিশ মুস্তফা মনে করেন, সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে ভারতের সরে যাওয়াকে পাকিস্তান সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে। এই সুযোগে তারা নতুন চুক্তির আলোচনা শুরু করতে পারে। এতে তারা পূর্ব দিকের নদীগুলোর ওপরও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে পারে।

কিন্তু পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী আসলামের মতে, দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো উপায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

আসলাম বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। পাকিস্তানকে পানি থেকে বঞ্চিত করা হলে আমরা সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করব। প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপের কথাও ভাবা হবে।’

আরও পড়ুন