কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ভারত। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমানোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ভারত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত বুধবার নয়াদিল্লি সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও চুক্তিটি টিকে ছিল।
সিন্ধু পানি চুক্তি কী
ভারতের উজান থেকে পাকিস্তানের সিন্ধু অববাহিকায় প্রবাহিত নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের।
সিন্ধু পানি চুক্তি অনুসরণ করেই এসব নদীর পানি ব্যবহার করা হয়। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় এ চুক্তি হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান তাতে স্বাক্ষর করে।
চুক্তিটির মাধ্যমে সিন্ধু ও এর উপনদীগুলোর পানিকে দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় এবং পানিবণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী ইরাবতী, বিপাশা ও শতদ্রুর পানি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় ভারতকে। আর পাকিস্তানকে পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদ-নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের অধিকাংশ পানি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
চুক্তিটি কোনো দেশ একতরফাভাবে স্থগিত বা বাতিল করার বিধান নেই। বরং এতে সুস্পষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
পানি নিয়ে যে উদ্বেগ কাজ করছে
পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী এ দুই দেশ বহু বছর ধরে ভারতীয় ভূখণ্ডে সিন্ধু ও এর উপনদীগুলোর ওপর বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিরোধ ও বিতর্কে জড়িয়েছে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জন্য পাকিস্তান এই নদীব্যবস্থার পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশটি বলছে, ভারত উজানে বাঁধ নির্মাণ করে অন্যায়ভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তবে ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতীয় বাঁধগুলো নদীর পানির প্রবাহ কমিয়ে দেবে বলে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান। দেশটির সেচনির্ভর কৃষির ৮০ শতাংশ পানি জোগায় এসব নদী। দেশটি সাম্প্রতিক দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং পরে একটি সালিশি আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে।
ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে। দেশটি বলেছে, সিন্ধু চুক্তির আওতায় কিশানগঙ্গা ও রাটলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ বৈধ। অভিযোগ নিষ্পত্তিতে এমন বিলম্ব এড়াতে চুক্তি সংশোধনের দাবিও তুলেছে ভারত।
চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তে কী পরিবর্তন আসতে পারে
চুক্তি স্থগিত করা হলেও পাকিস্তানে পানি প্রবাহে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, পানি সংরক্ষণের যথেষ্ট সক্ষমতা নেই ভারতের।
তবে ভারতের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের কৃষিব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, চুক্তি স্থগিতের ফলে ভারত ব্যারাজ বা বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার তথ্য বা বন্যাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাগাভাগি না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা আরও জানান, শুষ্ক মৌসুমে ভারতের ন্যূনতম পানি ছাড়ার বাধ্যবাধকতাও আর থাকছে না।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জন্য পাকিস্তান এই নদীব্যবস্থার পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশটির বলছে, ভারত উজানে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করে অন্যায়ভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তবে ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতের এ সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দপ্তর থেকে গত বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চুক্তিটি একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায়। এটি একতরফাভাবে স্থগিত করার কোনো বিধান নেই।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সিন্ধু পানি চুক্তির আওতায় পাকিস্তানের প্রাপ্য পানি আটকে দেওয়া বা অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা এবং ভাটি অঞ্চলের অধিকার হরণ করাকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচনা করা হবে এবং পূর্ণ শক্তি দিয়ে এর জবাব দেওয়া হবে।
ভারতের নদীগুলো উজানে আর পাকিস্তানের নদীগুলো ভাটিতে অবস্থিত।
চুক্তি স্থগিত করা হলেও পাকিস্তানে পানি প্রবাহে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, পানি সংরক্ষণের যথেষ্ট সক্ষমতা নেই ভারতের।
পাকিস্তান কৃষি গবেষণার হেড অব প্রোডাক্ট ঘশারিব শাওকত সিন্ধু চুক্তিকে দেশের কৃষি খাতের মেরুদণ্ড বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি (ভারতের চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত) আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎকে টালমাটাল করে তুলবে। পানির প্রবাহ অনিয়মিত হয়ে গেলে গোটা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে—বিশেষত যেসব ফসল সেচের ওপর নির্ভরশীল যেমন গম, চাল এবং আখ।’
ঘশারিব শাওকত আরও বলেন, ‘ফসলের ফলন কমে যেতে পারে। খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে। খাদ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর ক্ষুদ্র কৃষক, যারা স্বল্প মুনাফায় কাজ করেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ভুগবেন।’
পাকিস্তানের জাতীয় কৃষক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খালিদ হুসেইন বাট ভারতের এ পদক্ষেপকে আক্রমণাত্মক হিসেবে অভিহিত করেছেন। লাহোর থেকে তিনি বলেন, ‘এটি আসলেই যুদ্ধের শামিল। আমরা ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির সংকটে আছি। এ বছর বৃষ্টি কম। তুষারও কম গলেছে। ফলে পানির স্তর গত বছরের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম।’