মার্কিন আগ্রাসনের ফল এখনো ভোগ করছে ইরাকবাসী
ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ২০ বছর হয়ে গেল। যে কারণ দেখিয়ে এই আগ্রাসন হয়েছিল, তা ছিল মিথ্যা। তার ফল এখনো ভোগ করতে হচ্ছে। দুই দশক পরও ইরাকে সহিংসতা, হত্যা থামেনি। গত ফেব্রুয়ারিতেও বোমা, গুলি ও অন্য সহিংসতার বলি হয়েছেন ৫২ জন। ২০০৩ সালের মার্চে যে আগ্রাসন শুরু হয়েছিল, এটি তারই প্রভাব।
মার্কিন জোটের আগ্রাসন ও প্রচারের সামনে ইরাক কিছুই করতে পারেনি। সেই জোটে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ছিল অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ড। অভিযান চালানোর তিন সপ্তাহের মধ্যে সাদ্দাম হোসেনের শাসনের পতন ঘটে।
রণতরি ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনের ডেকে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ঘোষণা করেন, মিশন সফল।
সেই সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটসঙ্গীরা ২৯ হাজার ১৬৬টি বোমা ও রকেট ইরাকে ফেলেছিল। এতে ইরাকি পরিকাঠামোর বড় অংশ মাটিতে মিশে গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের বেসরকারি সংস্থা বেবিকাউন্টের হিসাবে, ইরাক যুদ্ধে সাত হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিল। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ২ থেকে ১০ লাখের মধ্যে।
২০১১ সালে মার্কিন সেনা ইরাক ছাড়ে। পরে তারা ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আবার ফিরে আসে।
যুদ্ধজয়ের পরও শান্তি ফিরল না
যুক্তরাষ্ট্রের ধাঁচে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইরাকের পরিস্থিতি ও সামাজিক অবস্থান ছিল আলাদা। সেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত জটিলতা ছিল প্রবল। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারে থাকা প্রশাসনের সেই প্রস্তুতিও ছিল না। ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট বাগদাদে জাতিসংঘের অফিস চত্বরে বিস্ফোরণে ২২ জনের মৃত্যু হয়।
সাবেক ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জাবিয়ার সোলানা বলেছিলেন, যদি এই অভিযানের লক্ষ্য থাকে ইরাককে সন্ত্রাসমুক্ত করা, তার পুনর্গঠন ও সর্বস্তরে সুরক্ষা বাড়ানো, তাহলে এই লক্ষ্যপূরণ হয়নি।
আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গ
আইনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাই অ্যামবোস জানিয়েছেন, ‘ইরাকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তা জাতিসংঘের চার্টার ও আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে এই আগ্রাসন হয়নি। তাহলে একমাত্র আত্মরক্ষার জন্যই এ ধরনের আগ্রাসন করা যেতে পারে।’
অ্যামবোস আরও বলেন, ‘এখানে আত্মরক্ষার কোনো বিষয় ছিল না।’ তা ছাড়া সেই সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানও বলেছিলেন, ওই আগ্রাসন ‘বেআইনি।’
জার্মানি এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। তবে জার্মানি গোয়েন্দা তথ্য ও অর্থ দিয়ে এই আগ্রাসন সমর্থন করেছিল। এভাবে তারা বেআইনি আগ্রাসনকে সমর্থন করেছিল বলে অ্যামবোস জানিয়েছেন।
অত্যাচার ও যুদ্ধাপরাধ
২০০৪-এর প্রথম দিকে ইরাকে যুদ্ধাপরাধ ও অত্যাচারের যে খবর সামনে আসে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হয়। সাদ্দামের আমলে কুখ্যাত জেলে মার্কিন আগ্রাসনের সময়কার যে ছবি সামনে আসে, তাতে শিউরে উঠতে হয়।
মার্কিন সেনারা বেসামরিক মানুষের ওপরও অত্যাচার করে। ২০০৫-এ হাদিথাতে মার্কিন নৌসেনা গুলি করে ২৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। ২০০৭-এ মার্কিন কনট্রাক্টর গুলি করে ১৭ জনকে মারে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন হেলিকপ্টার নিরপরাধ মানুষের ওপরও আক্রমণ চালিয়েছিল।
মিথ্যা যুক্তি
যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, ইরাকের হাতে এমন অস্ত্র আছে, যা দিয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালানো সম্ভব। দেখা গেছে, এমন কোনো অস্ত্র ইরাকের হাতে ছিল না। তাদের এই যুক্তি মিথ্যা ছিল।
অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল, সাদ্দামের সঙ্গে আল-কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের সম্পর্ক ছিল। এই যুক্তিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট বলেছেন, ‘আসলে যুক্তরাষ্ট্র আগে ঠিক করে নিয়েছিল তারা কী করবে। তারপর তারা যুক্তি সাজিয়েছিল। এমন নয়, গোয়েন্দারা এসব তথ্য দিয়েছিলেন। এসব যুক্তি তৈরি করা হয়েছিল।’