মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: কম্বোডিয়ায় ‘স্বৈরশাসক’ বাবার উত্তরসূরি কে এই হুন মানেত
প্রায় চার দশক পর ক্ষমতা ‘হস্তান্তর’ ঘটছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায়। তবে ক্ষমতার এই হাতবদল হচ্ছে দেশটির ‘স্বৈরশাসক’ প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের স্থলাভিষিক্ত হতে যাওয়া তাঁরই ছেলে সেনাপ্রধান হুন মানেতের কাছে।
গত রোববার কম্বোডিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি)। সিপিপির প্রধান প্রতিপক্ষ ক্যান্ডেললাইট পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। কারণ, নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে গত মে মাসে এই দলকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এ কারণে এ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক চলছে।
নির্বাচনের পরদিনই কম্বোডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন বলছে, দেশটিতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। সিপিপিকে কোনো শক্ত বিরোধী দলের মুখোমুখি হতে হয়নি। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, বিরোধী দলকে হুমকি এবং বিরোধীদের হয়রানি করা হয়েছে। আর নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি দেশটি।
সিপিপির নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন (৭০)। প্রায় চার দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন তিনি। হুন সেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, শিগগির তিনি তাঁর বড় ছেলে জেনারেল হুন মানেতের কাছে ক্ষমতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রিত্ব হস্তান্তর করবেন। মানেতের পড়াশোনা যুক্তরাষ্ট্রে, সামরিক প্রশিক্ষণও সেখানে।
কে এই হুন মানেত
হুন সেনের ছয় ছেলের মধ্যে সবার বড় হুন মানেত (৪৫) একজন চার তারকা জেনারেল। দেশটির সেনাবাহিনী রয়্যাল কম্বোডিয়ান আর্মির প্রধান তিনি। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক শেষ করেন মানেত। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন তিনি।
হুন মানেত সিপিপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এবং দলটির যুব শাখার কেন্দ্রীয় কমিটির উপপ্রধান। সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার আগে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চ পদে ছিলেন তিনি।
হুন মানেত যে তাঁর বাবা হুন সেনের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। সিডিনিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লোবি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত দুই বছর বিভিন্ন দেশের নেতা, আইনপ্রণেতা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁকে বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে।
তবে মানেতের রাজনৈতিক অবস্থানে পশ্চিমে পড়াশোনা করার বিষয়টি যে প্রভাব ফেলেছে, তার তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। গত সেপ্টেম্বরে সিপিপি–সমর্থিত একটি সংবাদপত্র খেমার টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মানেতের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তাতে বলা হয়, কম্বোডিয়ার জন্য সম্ভাব্য হুমকিগুলো চিহ্নিত করার ক্ষমতা আছে মানেতের। এ হুমকি মূলত রাজনৈতিক বিরোধীরা।
খেমার টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশে সিপিপির ভাবমূর্তি বাড়ানোর কাজে বড় ভূমিকা রয়েছে মানেতের। তাঁর এ অবদানের কারণে বিদেশে দলটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও ইতিবাচক হয়েছে। এ ছাড়া প্রবাসী সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করতে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক শাখাও খুলেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিত ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লি মরগেনবেশার বলেন, ‘মানেতই আসলে পরবর্তী স্বৈরশাসক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর থেকেই তিনি সিপিপির ভেতর ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমর্থন বাড়ানো এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব ঘটনার মাধ্যমে আসলে আমাদের বোঝা উচিত যে মানেত কী হতে চাইছিলেন।’
কেমন নেতা হবেন মানেত
অনেকের ধারণা, পশ্চিমে পড়াশোনা করে আসা হুন মানেত হয়তো বাবা হুন সেনের মতো শাসক হবেন না। কিন্ত অনেকে আবার এটা মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে, পশ্চিমা সমাজে বেড়ে উঠলেও বিপুল ক্ষমতা আর বিত্তবৈভবের মধ্যে বড় হওয়া মানেত বাবার মতোই স্বৈরশাসক হবেন।
লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ভিজিটিং ফেলো চেংপোর অন বলছেন, সিপিপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সম্ভবত তাঁদের সরকারি দায়িত্ব নিজেদের সন্তানদের হাতে তুলে দেবেন। যদিও তাঁরা দলের জ্যেষ্ঠ পদে নিজেরাই থেকে যাবেন।
চেংপোর অনের মতে, নতুন মন্ত্রিসভার তরুণ সদস্যদের কিছুটা স্বাধীনতা অর্থাৎ নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে। তবে বড় বড় সিদ্ধান্ত বড়দের অনুমোদন নিয়েই নিতে হবে।
হুন মানেতের সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো হতে যাচ্ছে সরকারের দুর্নীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত সংকট মোকাবিলা। কারণ, দেশটিতে বন্যা দিন দিন আরও বাড়ছে, একই সঙ্গে খরাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে দেশটির অর্থনীতির বড় অংশ হচ্ছে কৃষি।
এদিকে চীনের সঙ্গে কম্বোডিয়ার মৈত্রীর বিষয়টিও নজরে রাখবে পশ্চিমা দেশগুলো। চীন যে দক্ষিণ চীন সাগরের একটা অংশ নিজেদের বলে দাবি করছে, এ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান যে ভূমিকা রাখতে পারছে না, তার বড় এক কারণ কম্বোডিয়া। বেইজিংয়ের পক্ষে কম্বোডিয়ার এমন অবস্থান নিয়ে অসন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পশ্চিমা মিত্ররা।
হুন মানেত সম্পর্কে কূটনীতিক ও থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোমিয়া বলেন, তিনি একটি চরম স্বৈরাচারী সরকার দেখে বড় হয়েছেন। তাঁর পরিবার পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। হুন মানেত সরকারে গিয়ে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব বিষয়ে উদারনীতি গ্রহণ করেন, তাহলে এতে দেশের রাজনীতিতে তার পরিবারের আধিপত্যের অবসান শুরু হবে। তিনি কেন এমনটা চাইবেন?
হুন মানেত কেমন শাসক হবেন, সেই ভবিষদ্বাণী করতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উনের প্রসঙ্গ টানলেন সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নন স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো জন ব্রাডফোর্ড। তিনি বলেন, ‘উত্তর কোরিয়াতেও তো আমরা একজন স্বৈরশাসককে দেখছি যে পড়েছে সুইজারল্যান্ডের স্কুলে। সুইজারল্যান্ডের সমাজের যে শিক্ষাদীক্ষা এর প্রতিফলন তো তার মধ্যে দেখা যায় না।’