জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাসের জন্য মনোনীত জমিটি মূলত ফিলিস্তিনিদের মালিকানাধীন। এ নিয়ে গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইসরায়েলের হাইফাভিত্তিক আদালাহ লিগ্যাল সেন্টার*। তাতে দেখানো হয়েছে কীভাবে ১৯৪৮ সালে নাকবার সময় ইসরায়েল এ জমির মালিকানা চুরি করেছে। এমন সময় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো, যার কিছুদিন আগে (জুলাই মাস) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেরুজালেম সফর করে গিয়েছিলেন।
ওই জমির মূল মালিকদের বংশধরদের মধ্যে পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি আমেরিকানরাও রয়েছেন। আদালাহ, এই বংশধরদের পাশাপাশি তাদের জেরুজালেমের সম্পত্তির মালিকানার প্রমাণপত্রগুলো হাজির করেছে। আইনি সহায়তাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানের দাবি, বাইডেন প্রশাসন বিষয়টি জানতে পেরে চোরাই এই ভূমিতে দূতাবাস নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে।
১৯৪৮ সালের পর, ইসরায়েল বিশেষ করে ‘অনুপস্থিত ব্যক্তির সম্পত্তি আইনের’ (অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি ল) মাধ্যমে পশ্চিম জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ও সম্পত্তি চুরিকে বৈধতা দেয়। ১৯৫০ সালের এই আইন নাকবা শরণার্থীদের ‘অনুপস্থিত’ ঘোষণা করে।
আদালার এই তথ্য উদ্ঘাটন ও নিজেদের জমি পুনরুদ্ধারে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম আমার (লেখক) কাছে আমার অস্তিত্ব মনে হয়। কারণ, তারা (ইসরায়েল) আমাদের দাদাদের সঙ্গে অতীতে একই কারণে (জমি দখলে নিতে) যুদ্ধের প্রতিধ্বনি করেছিল।
১৯৪৮ সালের পর, ইসরায়েল বিশেষ করে ‘অনুপস্থিত ব্যক্তির সম্পত্তি আইনের’ (অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি ল) মাধ্যমে পশ্চিম জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ও সম্পত্তি চুরিকে বৈধতা দেয়। ১৯৫০ সালের এই আইন নাকবা শরণার্থীদের ‘অনুপস্থিত’ ঘোষণা করে। এমনকি এসব ব্যক্তি যদি পূর্ব জেরুজালেমেও থেকে থাকে। এ ছাড়া ইসরায়েলি সরকার বন্দী ফিলিস্তিনিদেরও অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করে এবং তাদের সম্পদ দখলে নেওয়াকে বৈধ মনে করে।
ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরে আসা ঠেকাতে আইনি ওই জোচ্চুরি করেছে, তা একটি তারবার্তা থেকে স্পষ্ট। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জেরুজালেমে দায়িত্বরত মার্কিন কনসাল জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রে ওই তারবার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। তারবার্তায় তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিজ বসতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনাকে ‘নস্যাৎ’ করার চেষ্টা করছে। অথচ ইসরায়েলের সেই উদ্যোগ ছিল ওই মাসের শুরুতে জাতিসংঘে পাস হওয়া একটি প্রস্তাবের বিরোধী। ওই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রও সমর্থন দিয়েছিল।
পশ্চিম জেরুজালেমে অনেক ফিলিস্তিনির মতো আমার (লেখক) পরিবারও বসতিহারা একটি পরিবার।
ফিলিস্তিনের বিখ্যাত লেখক ও চিকিৎসক জাদা কারমি। এখানকার জীবনের কথা উঠে এসেছে ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথার গ্রন্থ ‘ইন সার্চ অব ফাতিমা’–তে। কারমি এই গ্রন্থে লিখেছেন, কাতামনে তাঁদের ছিল বাগানবাড়ি, ঘরটি ছিল পাথর দিয়ে তৈরি। আর বাগান ছিল সাইট্রাস (কমলাজাতীয় ফল) ও জলপাই গাছে ভরা। নাকবার সময় কাতামন থেকে কারমির পরিবারকে জোর করে উৎখাত করা হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল আট বছর।
আমাদের মরূদ্যান
দখলদারি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগে আল-কাতামনে আমার দাদার একটি বাড়ি ছিল। কাতামন হলো জেরুজালেমের এমন একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ শহর, যা ওল্ড সিটি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত কাতামনে ৪৯ একর জমির ওপর ফিলিস্তিনিদের ২০৪টি বাড়ি ছিল। ওল্ড সিটির ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ থেকে বাঁচতে এই শহরটি মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির জেরুজালেমের বাসিন্দারা গড়ে তুলেছিলেন।
কাতামনের বাসিন্দারা ছিলেন মূলত মুসলিম ও খ্রিষ্টান। এর বাইরে কিছু বিদেশিও ছিলেন। এই শহরেই বেড়ে উঠেছেন ফিলিস্তিনের বিখ্যাত লেখক ও চিকিৎসক জাদা কারমি। এখানকার জীবনের কথা উঠে এসেছে ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথার গ্রন্থ ‘ইন সার্চ অব ফাতিমা’–তে। কারমি এই গ্রন্থে লিখেছেন, কাতামনে তাঁদের ছিল বাগানবাড়ি, ঘরটি ছিল পাথর দিয়ে তৈরি। আর বাগান ছিল সাইট্রাস (কমলাজাতীয় ফল) ও জলপাই গাছে ভরা। নাকবার সময় কাতামন থেকে কারমির পরিবারকে জোর করে উৎখাত করা হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল আট বছর।
১৯৪৮ সালে সবকিছু পাল্টে যায়। আমার পরিবার উৎখাত হয়ে পূর্ব জেরুজালেমে আশ্রয় নেয়। আর দাদার জমি ফেলা হয় ইসরায়েলি ‘অ্যাবসেন্টি’ আইনের গ্যাঁড়াকলে। অথচ দাদা কাতামন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই অবস্থান করতেন।
আমি আমাদের কাতামনের বাড়ির দলিলপত্র নিরিখ করে দেখেছি। এসব নথি দাদা ও বাবা পরম যত্নে ধরে রেখেছিলেন। নথি ঘেঁটে দেখতে পাই কাতামনের বাড়িটি দাদার নামে ১৯৩৯ সালের ২১ এপ্রিল (নাকবার ৯ বছর আগে) দাদার নামে রেজিস্ট্রি করা। তিনি এটি কিনেছিলেন আরেক ফিলিস্তিনির কাছ থেকে।
তবে ১৯৪৮ সালে সবকিছু পাল্টে যায়। আমার পরিবার উৎখাত হয়ে পূর্ব জেরুজালেমে আশ্রয় নেয়। আর দাদার জমি ফেলা হয় ইসরায়েলি ‘অ্যাবসেন্টি’ আইনের গ্যাঁড়াকলে। অথচ দাদা কাতামন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই অবস্থান করতেন।
ওই জমির দলিল আমার হাতে রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কীভাবে অ্যাবসেন্টি প্রপার্টির কাস্টডিয়ান জমিটি ১৯৫৭ সালের ২৮ জুলাই ইসরায়েলের ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কাছে বিক্রি করে দেয়। এটা এ জন্য করা হয়েছে, যাতে সহজে নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলা যায়।
আইনগত বৈষম্য
১৯৭০ সালে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে লিগ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যাটার্স ল পাস হয়। ওই আইনের সারমর্ম হলো, পূর্ব জেরুজালেম থেকে সরে আসা ইহুদিদের জন্য ‘অ্যাবসেন্টি ল’ কার্যকর হবে না। তারা পুনরায় তাদের বসতিতে ফিরতে পারবে। অথচ একই আইনে কীভাবে পশ্চিম জেরুজালেমের অধিবাসীদের জন্য এ বিধান রাখা হয়নি, যারা নাকবার সময় পূর্ব জেরুজালেমে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
আমার দাদা ওই জমির মালিকানা ফিরে পেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এ জন্য তিনি ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা জেরুজালেমের একজন বাসিন্দা হিসেবে অ্যাবসেন্টি প্রপার্টির কাস্টডিয়ান বরাবর একটি চিঠি লেখেন। তিনি চিঠিতে ওই জমি ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। চিঠিতে দাদা উল্লেখ করেন যে তিনি জেরুজালেমেই অবস্থান করছেন এবং ওই জমিতে খুব বেশি সময় অনুপস্থিত ছিলেন না। তিনি চিঠিটি এই বলে শেষ করেন, ‘এই বাড়ি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এর সঙ্গে অন্য কারও কোনো সম্পর্ক নেই।’
এর এক মাসের মাথায় জেরুজালেমের অ্যাবসেন্টি প্রপার্টির কাস্টডিয়ান দাদার ওই চিঠির জবাব দেয়। সেখানে অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি ল-কে উদ্ধৃত করে দাদার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
আমার হাতে যে কাগজপত্র আছে এবং বাবা যা জানতেন, তার ওপর ভরসা করে আমি দাদার ওই বাড়িটি ঠিক কোন জায়গায় ছিল, তা চিহ্নিত করি এবং গত বছরের গ্রীষ্মে সেখানে বাবাকে নিয়ে যাই। কিন্তু আমরা বাড়িটি খুঁজে পেয়েও আনন্দিত হতে পারিনি। কারণ, বাড়িটি একটি ইহুদি ইসরায়েলি পরিবারের দখলে রয়েছে। দাদার ওই বাড়ি অবিকল রয়েছে। শুধু তাঁর একতলা বাড়িটির ওপর বাড়তি দুটো তলা যোগ করা হয়েছে। আমি ঘুরে ঘুরে এলাকাটি দেখলাম। সেখানে আমি ফিলিস্তিনি অস্তিত্বের প্রমাণ দেখেছি আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অনুভব করেছি।
১৯৭০ সালের আইনের কারণে ইহুদিরা পূর্ব জেরুজালেমে বিশেষ করে শেখ জারাহ ও সিলওয়ানে তাঁদের সম্পত্তি ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত ইসরায়েলের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম জেরুজালেমে তা পারছে না।
ইহুদিদের বসতি স্থাপনের জন্য যেখানে শেখ জারাহ, সিলওয়ান ও পূর্ব জেরুজালেমের অন্যান্য এলাকায় ফিলিস্তিনিরা উচ্ছেদ আদেশের মুখোমুখি হচ্ছে, সেখানে আমি এই অবিচার সম্পর্কে চিন্তা করা বন্ধ করতে পারি না।
তারা দাবি করছে, জেরুজালেম একটি অবিভক্ত শহর। অথচ এখন পর্যন্ত সেখানে দুই ধরনের আইন দুই ধরনের মানুষকে অসমভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা (ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ) দাবি করে আমাদের অধিকার রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, তারা শুধু আমাদের অস্তিত্বকে সহ্য করে মাত্র। আমাদের ভোটের অধিকার নেই, বাসস্থানের অধিকার নেই, সম্পত্তির অধিকার নেই। আমাদের পৈতৃক বাড়িগুলো চুরি হয়ে গেছে। আমাদের ইতিহাস চুরি হয়ে গেছে।
নোট: ১. নিবন্ধের লেখক জালাল আবুখাতের জেরুজালেমের অধিবাসী। তিনি স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন।
২. *ইসরায়েলে অবস্থিত আদালাহ লিগ্যাল সেন্টার ফিলিস্তিনিদের দ্বারা পরিচালিত একটি আইনি সহায়তাদানকারী অলাভজনক ও অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান।
অনুবাদ: মো. ছানাউল্লাহ