ভারত–ইরানকে নিয়ে নতুন বাণিজ্যপথ চালুর উদ্যোগ রাশিয়ার

২০৩০ সাল নাগাদ আইএনএসটিসি রুট দিয়ে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টন পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাণিজ্য বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগর হয়ে শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারের খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। তবে কৃষ্ণসাগরের রুট বন্ধ রাখলেও বিকল্প হিসেবে পুরোনো একটি রুট সক্রিয় করার চেষ্টা করছে মস্কো। যদিও অনেক আগে থেকেই ইরান ও ভারতকে যুক্ত করে উচ্চাভিলাষী বাণিজ্যপথ গড়ার স্বপ্ন দেখে আসছে ক্রেমলিন।

গতকাল বুধবার আল–জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, যে রুটটি চালুর চেষ্টা করছে রাশিয়া, তার নাম ইন্টারন্যাশনাল নর্থ–সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর (আইএনএসটিসি)। এটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে শুরু করে মস্কো, ইরানের তেহরান, ইস্পাহান হয়ে ভারতের মুম্বাই আসবে। এর দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার। এতে যুক্ত রয়েছে মহাসড়ক, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দর।

রাশিয়ার বেশির ভাগ পণ্য সরবরাহব্যবস্থা ইউরোপকেন্দ্রিক। তাই ইউক্রেন যুদ্ধে বড় ধাক্কা খেয়েছে মস্কো। অন্যদিকে ভারত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, চীন ও পশ্চিমের দেশগুলোয় বাণিজ্য বিস্তারে আগ্রহী। তবে ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
গুলশান সচদেব, দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই রুটকে বিশ্ববাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মস্কোর। ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই স্বপ্ন পূরণের পথকে ত্বরান্বিত করেছে।

এর অংশ হিসেবে গত জুনে ইরান প্রথমবারের মতো একটি পাইলট প্রকল্প ঘোষণা করে। এর আওতায় আইএনএসটিসি রুট ধরে দেশটির বন্দরআব্বাস থেকে দুই কনটেইনার রাশিয়ার তৈরি পণ্য ভারতে পাঠায় ইরান। জুলাইয়ে এই রুট ধরে ভারতে আসে আরও ৩৯ কনটেইনার পণ্য।

এটা কেবল শুরু। এ বাণিজ্যপথে কনটেইনার ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ আইএনএসটিসি রুট দিয়ে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টন পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বৈশালি বসু শর্মা, ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের সাবেক পরামর্শক।

ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের সাবেক পরামর্শক বৈশালি বসু শর্মা বলেন, ‘এটা কেবল শুরু। এ বাণিজ্যপথে কনটেইনার ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ আইএনএসটিসি রুট দিয়ে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টন পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পণ্যের ৭৫ শতাংশ পরিবহন করা হবে ইউরেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে।’

গত জুনে ইরান প্রথমবারের মতো একটি পাইলট প্রকল্প ঘোষণা করে। এর আওতায় আইএনএসটিসি রুট ধরে দেশটির বন্দরআব্বাস থেকে দুই কনটেইনার রাশিয়ার তৈরি পণ্য ভারতে পাঠায় ইরান। জুলাইয়ে এই রুট ধরে ভারতে আসে আরও ৩৯ কনটেইনার পণ্য।

পূর্বাঞ্চলের এই রুট সক্রিয় করতে মস্কো খুবই আগ্রহী বলে জানান হংকংভিত্তিক বিনিয়োগবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস দেভোনশায়ের–এলিস। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে অর্থনৈতিক চাপ এ বিষয়ে মস্কোর আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই বাণিজ্যপথের বিশেষ কৌশলগত ও বাণিজ্যক গুরুত্বও রয়েছে। এই পথ ব্যবহার করে ভারত থেকে পশ্চিম ইউরোপে পণ্য পরিবহনের সময় ৪০ থেকে ৬০ দিন থেকে কমে ২৫ থেকে ৩০ দিনে নেমে আসবে। খরচ বাঁচবে প্রায় ৩০ শতাংশ। এই রুট মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানকে যুক্ত করলেও পাকিস্তানকে এড়িয়ে গেছে, যা ভারতের জন্যও সুবিধাজনক। এ ছাড়া ইরানের চাবাহার বন্দর নির্মাণে ২০১৬ সালে ভারত বিনিয়োগ করেছে। দিল্লি চায়, আইএনএসটিসি রুটে চাবাহার যুক্ত হোক।

আরও পড়ুন

বিশ্লেষকের অনেকের মতে, এই বাণিজ্যপথ দ্রুত সক্রিয় করা এখন রাশিয়া ও ভারতের অগ্রাধিকারে রয়েছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গুলশান সচদেব বলেন, রাশিয়ার বেশির ভাগ পণ্য সরবরাহব্যবস্থা ইউরোপকেন্দ্রিক। তাই ইউক্রেন যুদ্ধে বড় ধাক্কা খেয়েছে মস্কো। অন্যদিকে ভারত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, চীন ও পশ্চিমের দেশগুলোয় বাণিজ্য বিস্তারে আগ্রহী। তবে ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে এখন পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে বাণিজ্য বিস্তারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

তবে ভারতের সামনে এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে পশ্চিমা চাপ। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না দিল্লি ও মস্কো এতটা কাছাকাছি আসুক। এমনটা মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির পরিচালক ভেলিনা চাকারোভা। তিনি বলেন, দিল্লির ওপর কতটা চাপ প্রয়োগ করতে পারে পশ্চিমারা এবং এই চাপ দিল্লি কীভাবে সামাল দেয়—তার ওপর নির্ভর করবে এই বাণিজ্যপথের ভবিষ্যৎ। এ ছাড়া মস্কো ও তেহরানের ওপর এখনো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন

বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। এক সময় ইরান ও ভেনিজুয়েলা থেকে জ্বালানি তেল না কিনতে দিল্লির ওপর চাপ তৈরি করেছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ভেনেজুয়েলা থেকে তেল কিনতে শুরু করেছে। এমনকি যুদ্ধের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রুশ জ্বালানি কেনা এখনো পুরোপুরি বন্ধ করেনি ইউরোপ। তাই এখন ভারতের ওপর পশ্চিমা চাপ কতটা প্রবল হবে তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছে মস্কো–তেহরান–দিল্লি।

আরও পড়ুন