মিয়ানমারের শান রাজ্যের শহরে আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছে বিদ্রোহীরা
মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি (ইউডব্লিউএসপি) শান রাজ্যের হোপাং শহরে চলতি মাসের শুরুর দিকে নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছে। এই রাজ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জান্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুটি শহর দখল করে নিয়েছে।
ইউডব্লিউএসপি হচ্ছে ইউনসাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির (ইউডব্লিউএসএ) রাজনৈতিক শাখা। ইউডব্লিউএসএ হচ্ছে মিয়ানমারের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটি ওয়া সেলফ–অ্যাডমিনিস্টার্ড ডিভিশনের (ওয়া স্বায়ত্তশাসিত বিভাগ) আওতাধীন অঞ্চলে ‘ওয়া স্টেট পিপলস গভর্নমেন্ট’ চালু করেছে।
ইউডব্লিউএসপির এক ঘোষণায় বলা হয়, শহরে ‘কার্যকর সরকার চালু করতে’ দলটির ভাইস চেয়ারম্যান লুইও ইয়াগু দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।
সামরিক জান্তার ৭০০ সেনাসদস্যের আত্মসর্মপণের পর ৫ জানুয়ারি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স হোপাং ও প্যানলং শহর দখল করে। আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) সমন্বয়ে এই অ্যালায়েন্স বা জোট গঠন করা হয়েছে। দখলের পর ব্রাদারহুড জোট এ দুটি শহর তাদের মিত্র ইউডব্লিউএসএর কাছে হস্তান্তর করে।
ইউডব্লিউএসপি যদিও নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার দাবি করে থাকে এবং ব্রাদারহুডের অপারেশন ১০২৭–এর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। তবু প্রবলভাবে ধারণা রয়েছে, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে সামরিক জান্তাবিরোধী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
১০ জানুয়ারি হোপাংয়ে ইউডব্লিউএসপির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই শহরের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। সংগঠনটি বলেছে, ওয়া স্টেট গভর্নমেন্ট বছরের পর বছর ধরে অনুরোধের পর রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী ৪ জানুয়ারি দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছে।
দুই শহর হস্তান্তরের ফলে ওয়া সেলফ–অ্যাডমিনিস্টার্ড ডিভিশনের অধীন এলাকা পূর্বে চীন সীমান্তবর্তী সালউইন নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেল, শহরের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের পর গত সোমবার লুইও ইয়াগু প্রথমবারের মতো হোপাং টাউন হল পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি স্থানীয় বাসিন্দা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
অনুষ্ঠানে লুইও ইয়াগু বলেন, এই শহরে এখন কেবল তাঁদের দল ইউডব্লিউএসপি দায়িত্বে রয়েছে।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘তিনি (ইয়াগু) আমাদের কোনো জায়গাজমি ও সম্পত্তি বেচাকেনা করতে নিষেধ করেছেন। মনে হচ্ছে, তারা পরে খাজনা–কর বসাবে। মঙ্গমাউ জেলার সম্পাদক ইয়াগু মূলত শহরের প্রশাসনিক দিক তদারক করবেন। প্রশাসনে পরিবর্তন এলেও এখানে সবকিছু স্বাভাবিক।’
গতকাল বৃহস্পতিবার ইউডব্লিউএসপির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওয়া ইন্টারিম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি (ওয়া অন্তর্বর্তী প্রশাসন কমিটি) হোপাংয়ের শাসন পরিচালনা করবে। এতে রাজনৈতিক দল; বিচার বিভাগ; আর্থিক বিভাগ; পররাষ্ট্র বিভাগ; কৃষি, বন ও সেচ; নির্মাণ; শিল্প, খনি; স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে কমিটি শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে।
ইউডব্লিউএসপির ঘোষণায় বলা হয়েছে, হোপাংয়ে জান্তা সরকারের বেসামরিক কর্মকর্তা–কর্মচারীরা তাঁদের নিজ পদে বহাল থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা ওয়া স্টেটে নির্ধারিত স্কেলে বেতন পাবেন।
হোপাংয়ের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি শুনেছি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। পদ অনুযায়ী বেতন স্কেল হচ্ছে ১০০০ থেকে ৩০০০ ইউয়ানের (প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ থেকে ৪৬ হাজার ৪০০ টাকা) মধ্যে। তবে কোনো পেনশন নেই।’
হোপাংয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওয়া স্টেট পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে এসে গেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও দোকানপাট আবার স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করেছে।
২০০৮ সালে সামরিক জান্তার খসড়া সংবিধান অনুযায়ী হোপাং ও প্যানলং ওয়া সেলফ–অ্যাডমিনিস্টার্ড ডিভিশনের অংশ। তবে জাতীয় সরকার এখানে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। কোনো ধরনের সংঘাত ছাড়াই ইউডব্লিউএসপি এখন এ দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করা ইউডব্লিউএসপির সদস্য লুইও ইয়াগু তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। ২০১৮ সালে তিনি দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হন।
২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর মধ্য মিয়ানমার, কাচিন, কারেনি, চিন ও কারেন রাজ্যে প্রবলভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। পরে সামরিক জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য ২০২২ সালে নেপিডোতে তিন দফায় প্রতিনিধিদল পাঠায় ইউডব্লিউএসপি। ১৯৮৯ সালে সামরিক জান্তার সঙ্গে চুক্তির পর কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেনি দলটি।