দখল করা মারিউপোলে সস্তায় বাড়ি কিনতে ছুটছেন রাশিয়ার নাগরিকেরা

ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে রুশ কর্তৃপক্ষের গড়ে তোলা ভবন
ছবি: ওয়াক অ্যান্ড টক ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া

রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের মারিউপোল শহর দখলে নেওয়ার পর এক বছর পার হয়েছে। গণভোটের মাধ্যমে শহরটিকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে মস্কো। হামলায় গুঁড়িয়ে যাওয়া মারিউপোল নতুন করে সাজিয়ে তুলছে তারা। এখন অনেক রুশ নাগরিক শহরটিতে বাড়ি কিনতে চাইছেন।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, দখলের আগে দুই মাস মারিউপোল ঘিরে রেখেছিল রুশ বাহিনী। এ সময় তাদের গোলার আঘাতে শহরটির প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরের হাজার হাজার বেসামরিক বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। ৪ লাখ ৩০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার জনই সেখান থেকে পালিয়েছেন।

এখন মারিউপোলের রুশ কর্তৃপক্ষ শহরটিতে নতুন নতুন বাড়ি তুলছে। রাস্তায় ইউক্রেনীয় ভাষায় লেখা সংকেতগুলো বদলে রুশ ভাষায় লেখা হচ্ছে। স্কুলে পড়ানো হচ্ছে রাশিয়ার পাঠ্যক্রম। আর যাঁরা এখনো মারিউপোলে থেকে গেছেন, তাঁদের রুশ পাসপোর্ট নিতে জবরদস্তি করা হচ্ছে।

‘বাড়ি থেকে সাগর দেখা যায়’

রাশিয়ার অনেক নাগরিক মারিউপোলে বাড়ি কিনতে চাইছেন। দেশটির জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিকন্তাক্তে কয়েক মাস ধরে বাড়ির খোঁজ করছেন তাঁরা। এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসির। তাঁদের একজন রাশিয়ার মারমানস্ক শহরের বাসিন্দা ভ্লাদিমির।

বিবিসিকে ভ্লাদিমির বলেন, মারিউপোল সুন্দর একটি শহর। সেখানে একটি বাড়ির খোঁজ পেয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে রাশিয়ায় নিজের বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন। শিগগিরই পুরো পরিবার নিয়ে মারিউপোলে চলে যেতে চান। শহরটিতে বাড়ির দাম কম। আর সেখান থেকে সাগর দেখা যায়।

ভ্লাদিমির যা বলেছেন, তা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে এক বছর ধরে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ধ্বংস হওয়া মারিউপোলকে দ্রুত নতুন করে সাজানো হচ্ছে। মানুষের জীবন আবার আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।

যেমন রোসিয়া ১ নামের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, মারিউপোলে আগে যেখানে ধ্বংসস্তূপ ছিল, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে নতুন নতুন সব ফ্ল্যাট, নার্সারি ও স্কুল। সবকিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে এর সত্যতা পেয়েছে বিবিসি। এতে দেখা গেছে, গত এক বছরে শহরের উপকণ্ঠজুড়ে নতুন সুউচ্চ ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। শহরের উত্তর–পশ্চিম প্রান্তে একটি বড় এলাকায় নতুন আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘নেভস্কি’।

আরও পড়ুন

তবে মারিউপোলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অনেক এলাকা এখনো আগের অবস্থায় রয়েছে বলে স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে শহরের কেন্দ্রের দিকের অনেক বাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শহরের বাসিন্দা আলেকসান্দার (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ার টেলিভিশনে যা দেখানো হচ্ছে, তা ‘ভুয়া’। লড়াইয়ের সময় যেসব বাড়ি ধ্বংস হয়েছিল, তার মাত্র ১০ শতাংশ সংস্কার করা হয়েছে।

বিপত্তিতে বাড়ি হারানো স্থানীয় লোকজন

যুদ্ধে মারিউপোলের যেসব বাসিন্দা বাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের নতুন ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। তবে এসব ফ্ল্যাট পেতে নানা বিপত্তির মুখে পড়ছেন তাঁরা। অনেককে দীর্ঘ বিলম্বের মুখে পড়তে হচ্ছে। অনেককে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আরও পড়ুন

ভেতলানা (ছদ্মনাম) নামের একজন বিবিসিকে বলেন, তাঁর দাদির একটি বাড়ি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর ধ্বংস করা হয়েছিল। এর বিপরীতে তাঁর নতুন একটি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা ছিল। অনেক মাস অপেক্ষার পর গত মার্চে তাঁকে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে তিনি তা এখনো পাননি।

এদিকে আলেকসান্দারের মনে হয়েছে, নতুন ফ্ল্যাটগুলো শুধু যাঁরা রুশপন্থী তাঁদের দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যাঁদের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের অন্য কোনো বাড়ি থাকলে নতুন ফ্ল্যাট পাচ্ছেন না।

যেমন নতুন ভবন তোলার জন্য আনা নামের এক বাসিন্দার বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছিল। তিনি স্থানীয় একটি রুশপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলকে জানান, শহরের ৪০ কিলোমিটার দূরে তাঁর ৮ বর্গমিটারের একটি বাড়ি রয়েছে। তাই তাঁকে নতুন করে কোনো ফ্ল্যাট দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

বাড়ি কেনা নিয়ে শঙ্কা

মারিউপোলে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তা নিয়ে মোটেও বিচলিত নন অনেক রুশ নাগরিক। এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসির। ভ্লাদিমির বলছিলেন, ইউক্রেনীয়রাই শহরটি ধ্বংস করেছেন। রাশিয়া আবার শহরটি গড়ে তুলবে। তখন শহরটি আগের থেকেও ভালো হবে।

এদিকে ইউক্রেনের বাহিনী মারিউপোল শহরটি দক্ষিণ দিক থেকে দখলমুক্ত করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে কিয়েভ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন রাশিয়ার তাতারস্থানের বাসিন্দা ওক্সানা। কয়েক সন্তানের মা এই নারী বলেন, তিনি সব সময় সাগরের ধারে বসবাসের স্বপ্ন দেখেছেন।

ইউক্রেনের বাহিনী মারিউপোল দখলমুক্ত করলে, সেখানে বাড়ি কেনা রুশ নাগরিকেরা সমস্যায় পড়তে পারেন বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ওনা হ্যাথাওয়ে। তিনি বলেন, তখন তাঁদের বাড়ি কেনার স্বত্ব অবৈধ বলে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।

তবে এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওক্সানার। তিনি বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখা এখনো ছেড়ে দেইনি। আমার লক্ষ্য (মারিউপোলে) এমন একটি বাড়ি কেনা, যেটি কোনোভাবেই ১৮০ বর্গমিটারের কম হবে না।’

আরও পড়ুন