ইউক্রেন যুদ্ধ: সৌদিতে শান্তি আলোচনার আগে কী ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপ

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিফাইল ছবি: এএফপি

বিশ্বরাজনীতি আরেকটি টালমাটাল সপ্তাহ পার করছে। এর আগে হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগ্‌বিতণ্ডা দেখেছে বিশ্ববাসী। এরপর জেলেনস্কি ইউরোপ সফরে গিয়ে ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে বসেছেন। সম্মেলেনে যোগ দিয়েছেন।

ইউরোপের দেশগুলো এখন নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করার ভাবনা বাস্তবায়নে তৎপর। অন্যদিকে ইউক্রেনে নতুন করে হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আরেকটি উদ্যোগের দিকে এখন সবার নজর। সেটি হলো, আগামী সপ্তাহে সৌদি আরবে বৈঠকে বসছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের শান্তি আলোচকেরা।

এই বৈঠকের আগে সংশ্লিষ্ট বড় পক্ষগুলো কী ভাবছে? আসুন, জেনে নিই। বিবিসির চারজন সাংবাদিক গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র: ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে জোট বেঁধেছেন বলে বিরোধীদের মত

বিশ্লেষণ করেছেন: টম বেটম্যান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদদাতা, ওয়াশিংটন ডিসি

ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্সের অবমাননাকর আক্রমণের পর গত সোমবার ওয়াশিংটন ইউক্রেনের সঙ্গে সামরিক সহায়তা এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বন্ধ করে দিয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনের আত্মরক্ষার সক্ষমতায় এটা বেশ প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের ডেমোক্রেটিক বিরোধীরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে রাশিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, সেটা নিয়ে এখন আর প্রশ্ন রইল না।

মার্কিন প্রশাসন স্পষ্টভাবে বলেছে, এসব কর্মকাণ্ডকে বিরল খনিজ সম্পদ নিয়ে চুক্তিতে সই করা এবং দ্রুত যুদ্ধবিরতি নিয়ে সম্মত হতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর চাপ প্রয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের দূত জেনারেল কিথ কেলগ মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধের বিষয়টিকে লাঠি দিয়ে ‘খচ্চরের মুখের ওপর আঘাত করার’ মতো ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি তাদের মনোযোগ কেড়েছেন। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ... এটা (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আসলে যেটা চান) এখন পুরোটাই তাঁদের ওপর নির্ভর করছে।’

এত কিছুর পরও ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক শীর্ষ দলের কয়েকজন সদস্যের সমঝোতামূলক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সপ্তাহটি শেষ হচ্ছে। তাঁরাই সৌদি আরবে আগামী সপ্তাহে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।

এরই মধ্যে গত শুক্রবার মস্কোর সমালোচনা করেন ট্রাম্প। এটা বেশ বিরল একটি ঘটনা। ট্রাম্পকে সচরাচর রাশিয়ার সমালোচনা করতে দেখা যায় না। ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর আরও কড়া নিষেধাজ্ঞা এবং রুশ পণ্যে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলা বন্ধ করতে এমন হুমকি দেন ট্রাম্প।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির (বাঁয়ে) সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

গত বৃহস্পতিবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র টমি ব্রুসের কাছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ কর্তৃক ইউক্রেনে ইউরোপীয় শান্তিরক্ষীর উপস্থিতির বিষয়টি বাতিল করার প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটাকে পশ্চিমাদের ‘শত্রুতাপূর্ণ উদ্দেশ্য’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, এখানে ‘আপস করার’ কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু টমি ব্রুস প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, বিদেশি কোনো নেতা কিংবা মন্ত্রীর করা মন্তব্যের ওপর প্রতিক্রিয়া জানানো তাঁর কাজ নয়। যদিও তিনি জেলেনস্কির উদ্দেশ্যে ট্রাম্পের করা মন্তব্যের কথা (শান্তির জন্য প্রস্তুত নন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট) বারবার উল্লেখ করছিলেন।

আরও পড়ুন

রাশিয়া: ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ অব্যাহত, নেতারা পশ্চিমা বিভেদের দৃশ্য উপভোগ করছেন

বিশ্লেষণ করেছেন: ভিটালি শেভচেঙ্কো, বিবিসি মনিটরিং রাশিয়া সম্পাদক

ট্রাম্পের পক্ষ থেকে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকির আগপর্যন্ত, এমন একটি সপ্তাহ পার হয়েছে, যখন সব চাপ ছিল ইউক্রেনের ওপর। রাশিয়া অনেকটাই নির্ভার ছিল।

সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা পুরোদমে স্থগিতের ঘটনা প্রথমবারের মতো ইউক্রেনকে চরম ধাক্কা দিয়েছে। এটা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সম্ভাবনাগুলোকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

ইউক্রেনজুড়ে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয়, রাশিয়া বেশ খুশি। দেশটি এখনো জোর দিয়েই বলছে, ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ আসল লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবে। আরও ইউক্রেনীয় ভূমি দখল করে নিতে হবে।

রাশিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই কিংবা শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে কিয়েভের ওপর চাপ কমাতে ইউক্রেনের মিত্রদের উদ্যোগকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।

এ সপ্তাহে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মন্তব্য করেন, ‘ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র আর “আমাদের পক্ষে” নাও থাকতে পারে। আর এটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কানে সুমধুর গানের মতোই শোনাবে।’

এটি এমন একটি পরিস্থিতি হতে পারে, যেখানে পুতিন বসে বসে পশ্চিমা জোটে ফাটল দেখে দৃশ্যপট উপভোগ করতে পারেন। এটি এমন এক পরিস্থিতি, যা অর্জনের জন্য তিনি (পুতিন) দশকের পর দশক না হলেও অন্তত বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন।

পুতিন এটা অর্জন করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি চালিয়ে নয়, বরং ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় মিত্রের শ্বাসরুদ্ধকর ইউটার্নের কারণে। আগামী মঙ্গলবার সৌদি আরবে ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠকটি রুশ কর্মকর্তারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। যদিও তাঁরা বেশ আত্মবিশ্বাসী।

ইউক্রেনে চলমান সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য একত্র হন ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটের নেতারা। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, ২ মার্চ ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন: সপ্তাহব্যাপী ক্ষতবিক্ষত অবস্থা, জেলেনস্কি নতুন আলোচনায় প্রস্তুত

বিশ্লেষণ করেছেন: মাইরোস্লাভা পেটসা, বিবিসি ইউক্রেন এবং ড্যানিয়েল উইটেনবার্গ, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের জন্য এটি একটি ক্ষতবিক্ষত, আবেগপূর্ণ ও কর্মব্যস্ত সপ্তাহ ছিল। তিনি শান্তির প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক সহায়তা অক্ষুণ্ন রাখতেও লড়াই করছিলেন।

ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগ্‌বিতণ্ডার ফলাফল কিয়েভের ওপর আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যখন ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বন্ধের ঘোষণা দেন।

এ বিষয়ে ইউক্রেন সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র মন্তব্য করেছে, ‘বাতাসে বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ আছে।’ সূত্রটি আরও যোগ করে, ‘প্রেসিডেন্ট (জেলেনস্কি), তাঁর দলসহ পুরো দেশ এটা উপলব্ধি করতে পারছে।’

ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, জেলেনস্কিকে ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা’ চাইতে হবে। জেলেনস্কি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও পরবর্তী সময়ে জেলেনস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি হোয়াইট হাউসে ঘটে যাওয়া বাগ্‌বিতণ্ডাকে ‘দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সম্ভাব্য ক্ষতি সামাল দিতে জেলেনস্কি বসে থাকেননি। তিনি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন জোরদার করার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ মানুষকেও পাশে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে জেলেনস্কি যতটা সামরিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছিলেন, ততটা পাননি।

আরও পড়ুন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের প্রতি জেলেনস্কি ‘সমুদ্র ও আকাশে সীমিত পরিসরে যুদ্ধবিরতি’ সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটা মূলত ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া একটি ধারণা।

সৌদি আরবে আগামী সপ্তাহে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আলোচনার টেবিলে বসছেন ঠিকই, তবে শান্তির পথ এখনো অনিশ্চিত।

নানা বাধা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের (জেলেনস্কি) দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জোর দিয়ে বলে, ‘প্রেসিডেন্ট এখনো আগের অবস্থানে অটল আছেন। বছর তিনেক আগেই তিনি হত্যার শিকার হতে পারতেন। তখনো তিনি কিয়েভে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি যত বেশি চাপের মধ্যে থাকবেন, তত কঠোর হবেন।’

ইউরোপ: মার্কিন সমর্থন কমছে, ফ্রান্স কি পারমাণবিক ছাতা ছড়াতে পারবে

বিশ্লেষণ করেছেন: পল কিরবি, ইউরোপ ডিজিটাল সম্পাদক

ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো এত বেশি সম্মেলন করেছে যে চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় আরও সম্মেলন হবে।

ইউরোপের নেতারা হঠাৎই বুঝতে পেরেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তাঁরা যে ‘নিরাপত্তা ছাতার’ ওপর নির্ভর করে আসছেন, সেটা আর থাকবে না। ইউরোপের এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে শঙ্কাগুলো আরও দ্রুত সামনে আসছে।

ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ইউরোপের একটি বিস্তৃত ঐকমত্য রয়েছে। শেষমেশ শান্তিচুক্তি করা সম্ভব হলে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ‘আগ্রহীদের একটি জোট’ গড়ার প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও রাশিয়া এই ধারণা পছন্দ করছে না। তারপরও মাখোঁ আগামী মঙ্গলবার সেনাপ্রধানদের নিয়ে একসঙ্গে একটি পরিকল্পনা তৈরি করবেন।

কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হলো, ইউরোপ কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে? কেননা, বর্তমান পরিস্থিতিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন ‘স্পষ্ট ও বর্তমান বিপদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বলেছেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করার জন্য পাশে না থাকে, তাহলে আমাদেরই প্রস্তুত থাকতে হবে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে কোটি কোটি ইউরো ব্যয়ের পরিকল্পনার কথা বলছে।

মাখোঁ প্রাথমিকভাবে সম্মতি দিয়েছেন। তবে ফ্রান্সের ‘পারমাণবিক ছাতা’ কতদূর বিস্তৃত হবে, সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্যারিসের কাছ থেকেই আসবে।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইউরোপের দেশগুলো কি তাদের সম্পদ একত্র করতে এবং একে অপরের ওপর নির্ভর করতে পারবে?

লিথুয়ানিয়ার মতো ছোট দেশগুলোর সামনে এর কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু এটা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘আমাদের নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতাগার থাকলে, তবেই এটি নিরাপদ হতে পারে।’

আরও পড়ুন