এক বছর আগেও ভলোদিমির ও তাঁর সেনারা রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে বিএম-২১ গ্রাদ রকেট লঞ্চার দিয়ে একসঙ্গে ৪০টি ব্যারেল থেকে গোলা ছুড়েছে। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন একসঙ্গে তারা গুটিকয় ব্যারেল থেকেও হামলা চালাতে দুবার ভাবতে হচ্ছে।
গ্রাদের কমান্ডার ভলোদিমির বলেন, তাঁদের এখন পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই। অলস অস্ত্র ফেলে রাখতে হচ্ছে।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাহিনীর মধ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধে এখনো লড়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারা। সেখানে ইউক্রেনের বাহিনীকে গোলা ছুড়ে সহায়তা করতে এখনো ১৭তম ট্যাংক ব্যাটালিয়নের (ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনী) ডাক পড়ছে। এই শহরের বেশির ভাগ এলাকার দখল এখন রাশিয়ার কাছে। বেসরকারি ভাগনার বাহিনী শহরের পূর্ণ দখল নিতে কয়েক মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তাদেরও বেশ মূল্য দিতে হচ্ছে।

চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও পাকিস্তান থেকে সহায়তা পাচ্ছেন। তবে পাকিস্তানে তৈরি রকেটের মান ভালো নয়
ভলোদিমি, ইউক্রেনীয় কমান্ডার

বিবিসির প্রতিনিধি জনাথন বিল বাখমুতে কথা বলেন গ্রাদের কমান্ডার ভলোদিমিরের সঙ্গে। সেখানে অস্ত্রের ঘাটতির কথা বলেন ভলোদিমির। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন গাছের সারির আড়ালে অপেক্ষা করছি, তখন আমার কাছে একটি কল আসে। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি রুশ মর্টার বাংকার রয়েছে। সেটি লক্ষ্য করে রকেট লঞ্চার থেকে গোলা ছুড়তে হবে।’

ইউনিটের সদস্যরা ডালপালা সরিয়ে রকেট লঞ্চার নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে খালি মাঠে দ্রুত কাজ শুরু করেন। তাঁরা ব্যারেলগুলোকে যখন লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাক করলেন, তখন ইউক্রেনীয় একটি ড্রোন ওপর থেকে নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুর বিষয় ঠিক করে দিল।

ভলোদিমির বলেন, তাঁদের বলা হলো, তাঁদের প্রথম রকেটটি লক্ষ্যবস্তু থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে গিয়ে পড়েছে। এরপর তাঁরা উচ্চতা ঠিক করে আরও দুটি গোলা ছুড়ে দ্রুত গাছের আড়ালে চলে আসেন। এরপর খবর এল, এবার তাঁরা ঠিকভাবে আঘাত হানতে পেরেছেন।

কিন্তু ভলোদিমির এখন খুবই হতাশ। কারণ, এভাবে বেশি দিন আর চালাতে পারবেন না। অস্ত্রের ঘাটতির কথা জানিয়ে হতাশ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব সেনা এখানে মারা যাচ্ছে, আমরা তাদের আরও বেশি সহায়তা করতে পারতাম।’

আরও পড়ুন

বাখমুতে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা, বললেন, ‘আমরা ক্লান্ত’

ভলোদিমির বলেন, ইউক্রেন ইতিমধ্যে গোলাবারুদের মজুত শেষ করে ফেলেছে। ফলে অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও পাকিস্তান থেকে সহায়তা পাচ্ছেন। তবে পাকিস্তানের তৈরি রকেটের মান ভালো নয়।

পুরোনো অস্ত্রাগার ভরসা

বাখমুতে তীব্র লড়াইয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অবস্থা কী তা মানচিত্রে দেখানো হয়েছে
ছবি: এএফপি

যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ চেয়ে মিত্রদের প্রতি ইউক্রেন ততটা জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছে। এখন তাদের মূল মনোযোগ হলো বড় ধরনের আক্রমণ চালানো। একই সময়ে তাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত বিপুল গোলাবারুদ ব্যয় করতে হচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানসহ সম্প্রতি আধুনিক অস্ত্র এলেও ইউক্রেন মূলত তাদের সোভিয়েত আমলের পুরোনো অস্ত্রাগারের ওপরই বেশি নির্ভরশীল।

রাশিয়ার তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বুক এখনো তাদের কাছে অনেক মূল্যবান হাতিয়ার। এটি বিমান, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে।

এই অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে আকাশসীমায় রাশিয়াকে ঠেকানো যাচ্ছে। গম্বুজ আকৃতির রাডারসহ দীর্ঘকায় এই যানটিকে ছদ্মবেশে ঢেকে গভীর পরিখায় রাখা হয়েছে। এর ওপরের দিকে দুটি ধূসর বর্ণের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সাধারণত এটি চারটি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে।

বুকের কমান্ডার জোসেফের কাছে বিবিসির এই প্রতিবেদক বুক ক্ষেপণাস্ত্রের তীব্র ঘাটতির বিষয়টি সঠিক কি না জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে জোসেফ জোর দিয়ে বলেন, ‘না, এটা সত্য নয়।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, বুক-এর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ছে। ইউক্রেনের আরও বুক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

রাশিয়া-ইউক্রেনের কাছে বাখমুতের গুরুত্ব কেন এত বেশি

জোসেফ বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র নেই।’ অনেক সময় এগুলোর যন্ত্রাংশ ভেঙে যায় এবং আমাদের কাছে এর খুচরা যন্ত্রাংশ নেই। কারণ, ইউক্রেনে এসব যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। ইউক্রেনের কারখানায় এসব যন্ত্রাংশ তৈরি হয় না।’

আসলেই কি তারা গোপন কিছু প্রকাশ করেছে

চলতি মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কিছু নথি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বেশ কিছু নথি ‘অতি গোপনীয়’। এতে ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র, তালিকা ও ছবি।

৮০তম ব্রিগেডের প্যারাট্রুপারদের ইউক্রেনীয় সৈন্যরা বাখমুতের কাছে অবস্থান নিয়ে মর্টার শেল ছোড়েন। ১৬ মার্চ, ২০২৩
ছবি: রয়টার্স

জোসেফ ফাঁস হওয়া মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। উল্টো তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আসলেই কি তারা গোপন কিছু প্রকাশ করেছে? তিনি বলেন, ‘কেন আমরা মার্কিনদের ওপর রাগ করব? কারণ, তারা ২০ বছর ধরে রুশদের কাছে তথ্য দিয়েছে? হাস্যকর!’ তাঁর বিশ্বাস, রাশিয়া সব সময় ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে জানে।

তবে রাশিয়া এখনো ইউক্রেনের প্রত্যাশিত আক্রমণের সময় বা স্থান জানে না। আর এটিই হবে নিজেদের ভূখণ্ড পুনর্দখলে নেওয়ার চাবিকাঠি। পাশাপাশি ইউক্রেনকে সেই লড়াইয়ের জন্য নতুন ইউনিটকে অস্ত্র সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত করতে হবে। দুই পক্ষই বাখমুতের দখল নিতে সম্মুখসারিতে লড়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

বাখমুতে ‘রাশপুতিৎসা’ নিয়ে বিপাকে রাশিয়া-ইউক্রেন

পর্যাপ্ত সেনা আছে, গোলাবারুদ দরকার

বাখমুতের কাছে আরেকটি জায়গায় রাশিয়ার অগ্রগতি প্রতিহত করতে ইউক্রেনীয় সেনারা প্রতিদিন কামানের শত শত গোলা ছুড়ে যাচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা কিছু অস্ত্র ব্যবহার করছে। সেরহি ও তাঁর সদস্যরা যুক্তরাজ্যের তৈরি এল১১৯ হালকা আর্টিলারি বন্দুক চালাচ্ছেন। কিন্তু সেরহি বলেন, তাঁদের সীমিত আকারে গুলি ব্যবহার করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁরা প্রতিদিন গড়ে ৩০টি গুলি করছেন।

সেরহি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের পর্যাপ্ত সেনা আছে। কিন্তু আমাদের গোলাবারুদ দরকার। গোলাবারুদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

আরও পড়ুন

বাখমুতের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি রাশিয়ার ভাগনারপ্রধানের

সেরহির কাছে বিবিসির প্রতিবেদক জোনাথন এই বছরটি কি ইউক্রেন গঠনের না ভাঙার বছর—এমন প্রশ্ন রেখেছিলেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এ বছর আক্রমণে যাই এবং আমাদের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করি, তাহলে আমরা জিতব। কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে আরও ৫ থেকে ১০ বছর যুদ্ধ চালানোর মতো রসদ থাকবে না।’

গ্রাদের কমান্ডার ভলোদিমির হতাশা অন্যদের তুলনায় আরও স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘দেশ নিঃশেষ হয়ে গেছে, অর্থনীতিও।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ বছর যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে পশ্চিমা সমর্থনও কমে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা মিত্ররাও আমাদের সাহায্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, এতে আমরা উদ্বিগ্ন।’

আরও পড়ুন

বাখমুতের যুদ্ধে ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ শতাধিক রুশপন্থী সেনা হতাহত: ইউক্রেন