যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার মধ্যে ইউক্রেনের ওদেসায় কেন হামলা জোরদার করছে রাশিয়া

ইউক্রেনের ওদেসায় রুশ বিমান হামলার পর আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কৃষ্ণসাগর তীরের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী ওদেসায় রাশিয়ার হামলা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত সোমবার গভীর রাতে এমনই এক হামলায় বন্দর অবকাঠামো ও একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক গভর্নর। এর আগে গত সপ্তাহান্তেও ওদেসার আশপাশে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করেছে মস্কো।

সমুদ্রপথে ইউক্রেনের বৈদেশিক বাণিজ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য এ বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি রাশিয়া সরাসরি হুমকি দিয়েছিল, তারা সমুদ্রপথে ইউক্রেনের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

ওদেসায় এমন এক সময় রাশিয়ার হামলা বাড়ছে, যখন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে ওয়াশিংটন। গত শুক্রবার ফ্লোরিডায় মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। পরদিন শনিবার মার্কিন দূতেরা রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।

কিয়েভে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘বন্দর অবকাঠামো ও লজিস্টিকসে রুশ হামলার কারণে ওদেসার পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত সংকটাপন্ন। রাশিয়া আবারও ইউক্রেনের সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে এবং আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করছে।’

সর্বশেষ হামলায় যা ঘটেছে

ওদেসা আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের প্রধান ওলেহ কিপার বলেন, সোমবার রাতে রুশ হামলায় একটি বেসামরিক মালবাহী জাহাজ ও একটি গুদাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া একটি দোতলা আবাসিক ভবনের ছাদে আগুন ধরে গেছে।

উপপ্রধানমন্ত্রী ওলেকসি কুলেবা বলেছেন, শনিবার ওদেসার কাছের পিবদেনি বন্দরে হামলায় একটি জ্বালানি তেল সংরক্ষণাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগের দিন সেখানে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৮ জন নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হন।

ওদেসায় এমন এক সময় রাশিয়ার হামলা বাড়ছে, যখন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে ওয়াশিংটন। গত শুক্রবার ফ্লোরিডায় মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। পরদিন শনিবার মার্কিন দূতেরা রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।

গত সপ্তাহে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালায়। এতে ওদেসার জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন লাখো মানুষ।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও ক্রেমলিন আগেই জানিয়েছিল, চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে রাশিয়া পরিকল্পিতভাবেই ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।

বার্তা আদান-প্রদান মাধ্যম টেলিগ্রামে ওলেকসি কুলেবা গত শুক্রবার বলেন, দক্ষিণ পশ্চিমের পিবদেনি এলাকার মেয়াকি গ্রামের কাছে নিস্টার নদীর ওপর একটি সেতুতে ২৪ ঘণ্টায় পাঁচবার হামলা হয়েছে। এ সেতু দিয়ে ইউক্রেনের প্রায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। সেতুটি অচল হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মুখে।

কেন ওদেসাকে নিশানা করছে রাশিয়া

কুলেবা সতর্ক করে বলেছেন, ‘যুদ্ধের মনোযোগ এখন ওদেসার দিকে ঘুরে গেছে।’ তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের অর্থনীতি দুর্বল করতে হামলার ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে।

গত সপ্তাহে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালায়। এতে ওদেসার জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন লাখো মানুষ।

এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ব্যবহৃত রাশিয়ার ‘ছায়া নৌবহরের’ ওপর ড্রোন হামলার পাল্টা জবাবে তাঁরা কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিতে চায়।

ইউক্রেনের দাবি, এই ছায়া নৌবহর ব্যবহার করে রাশিয়া অবৈধভাবে তেল রপ্তানি করে যুদ্ধের অর্থ জোগাড় করছে।

ইউক্রেনের জন্য ওদেসা বন্দর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

ইউক্রেনের ওদেসায় রুশ বিমান হামলা পুড়ছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
।ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওদেসাকে বলা হয় ‘সমুদ্রের মুক্তা’। রাজধানী কিয়েভ ও খারকিভের পর এটিই ইউক্রেনের তৃতীয় জনবহুল শহর। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশই এই ওদেসা এবং এর কাছের পিবদেনি ও চোরনোমোরস্ক বন্দর দিয়ে হতো।

খেরসন ও মাইকোলাইভের মতো বন্দরগুলো এখন রাশিয়ার দখলে বা রুশ হামলার ঝুঁকিতে থাকায় ওদেসার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। বর্তমানে ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি গম ও ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশের একটি, যার সিংহভাগই যায় ওদেসা দিয়ে।

আরও পড়ুন

ওদেসা বন্দর অচল হলে কী ঘটবে

ওদেসা বন্দর পুরোপুরি অচল হয়ে পড়লে ইউক্রেনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। শিপিং ও লজিস্টিক খাতে ব্যাপক মাত্রায় কর্মসংস্থান হারাবেন মানুষ। স্থানীয় ব্যক্তিদের আয় প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। জাতীয়ভাবে রপ্তানি ক্ষমতা কমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়বে এবং ইউক্রেনের মুদ্রার মান কমে যাবে।

গত ছয় মাসে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে নৌযুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে। উভয় পক্ষই একে অপরের নৌ ও বাণিজ্যিক সম্পদকে নিশানা করছে।

কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন না এবং গুদামসংকটে পুরো গ্রামীণ অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। সরকার হারাবে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব।

আরও পড়ুন

সমুদ্রযুদ্ধের নতুন কৌশল

গত ছয় মাসে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে নৌযুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে। উভয় পক্ষই একে অপরের নৌ ও বাণিজ্যিক সম্পদকে নিশানা করছে। ইউক্রেন এখন ব্যাপকভাবে পানির নিচে চলাচলকারী ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার ছায়া নৌবহরে আঘাত হানছে। ১৯ ডিসেম্বর ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ট্যাংকারে হামলা চালিয়ে ইউক্রেন তাদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়াও ইউক্রেনের বাণিজ্যিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা বাড়িয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর ওদেসার কাছে একটি তুর্কি পতাকাবাহী জাহাজে ড্রোন হামলা তার প্রমাণ। বিশেষজ্ঞরা একে ‘অসম নৌযুদ্ধ’ হিসেবে দেখছেন, যেখানে ড্রোন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে অপরের অর্থনৈতিক ও সামরিক সরবরাহব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন