অবৈধ পথে অভিবাসন: অমূল্য জীবন নাকি স্বপ্নের ইউরোপ

অভিবাসনের কারণ ও প্রকৃতি স্থান-কাল সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অভিবাসীদের অনেকেই দালালদের মনগড়া কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নেন ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এ পথে প্রায়ই নৌকা ডুবে মৃত্যুর খবর আসে
ফাইল ছবি: এএফপি

পাঁচ দিন ধরে গন্তব্যহীনভাবে ভূমধ্যসাগরে ভেসে বেড়িয়েছেন তারেক (ছদ্মনাম)। তিনি জমি বিক্রি করে, নিজের চলতি ব্যবসা বন্ধ করে পরিবারের জমানো টাকায় ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উন্নত জীবনের আশায়।

প্রথমে বিমানযোগে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে মিসর, তারপর গাড়িতে লিবিয়া সীমান্ত থেকে আফ্রিকান ও বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে নৌকায় ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তারেক বলছিলেন, ‘বুঝতে পারছিলাম না দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়া ইতালি আসার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি না। অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি। এত কিছুর পরও যদি দেশে ফিরে আসি তাহলে আর বাড়িতে মুখ দেখাতে পারব না।’

ইতালিতে ঢুকতে ব্যর্থ হলে পরে তারেককে লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) সহযোগিতায় তাঁকে দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালে মে মাস পর্যন্ত চলা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ (সিএমএস) এক গবেষণার জন্য তারেকের সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন তিনি এই অভাবনীয় দুর্বিষহ যাত্রার কথা উল্লেখ করেন।

তারেক বলেন, ‘অনেকেই তো এইভাবে ইতালি যায়। শুনেছি তাদের অর্ধেকের বেশিই নাকি রাস্তায় মারা যায়। সেদিক থেকে দেখলে আমি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।’

দালালদের বড় অংশ পূর্বপরিচিত

ইউরোপীয় বর্ডার অ্যান্ড কোস্টগার্ড এজেন্সির (ফ্রন্টেক্স) তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোট ৫৫ হাজার ২১৮ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন পথে অবৈধ উপায়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের অধিকাংশই তরুণ। তাঁরা কেন তাঁদের জীবনের সুবর্ণ সময়কে দেশের উন্নয়নে কাজে না লাগিয়ে জীবনকে বাজি রেখে এই অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছেন, কোন সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ (সিএমএস) তাদের গবেষণায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।

অভিবাসনের কারণ ও প্রকৃতি স্থান-কাল সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অভিবাসীদের অনেকেই দালালদের মনগড়া কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই দালালদের একটি বড় অংশই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বন্ধু অথবা প্রতিবেশী। তাই সহজেই তারা আস্থা অর্জন করে। এ আস্থাকে পুঁজি করে অভিবাসীদের তুলনামূলক সহজ, নিরাপদ ও দ্রুত যাত্রার আশ্বাস দেওয়া হয়। ইউরোপে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়। পরিচিত হওয়ায় অভিবাসীরা দালালদের মিথ্যা আশ্বাসকে সরল মনে মেনে নেয়।

এই দালালদের আবার বিভিন্ন স্তর আছে। অভিবাসীদের অনেকেই বিদেশে যাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে বিষয়ে জানে না। দালালেরা সম্ভাব্য অভিবাসীদের অজ্ঞতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে প্রলুব্ধ করে, নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা দেয়। মিসর, দুবাই, মরক্কো বা তুরস্কের মতো তৃতীয় দেশ হয়ে সমুদ্রপথে বড় জাহাজে যাত্রা করে ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেয়।

আরও পড়ুন

অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিবাসীদের সমুদ্রপথে যাত্রার ঝুঁকি বা সমুদ্র নিয়ে কোনো ধারণা থাকে না। রাজি হলে অভিবাসীদের প্রথমে জেলা পর্যায়ের এবং পরে ঢাকার এজেন্টদের কাছে পাঠানো হয়। স্থানীয় দুর্নীতগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় অতি সহজেই পাসপোর্ট, টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই এজেন্টদের অনেকেই একসময় অভিবাসী ছিলেন। ইউরোপে যেতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরে তাঁরা নিজেরাই এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।

দালালদের আরেকটি চক্র ইউরোপের ‘স্টেপিং স্টোন’ (সহজ প্রবেশদ্বার) হিসেবে পরিচিত দেশ রোমানিয়া ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্র, ভ্রমণ ও ভিজিটিং ভিসা ব্যবস্থা করায় সিদ্ধহস্ত। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তাঁদের পরিচিত বা পরিবারের সদস্য, যাঁরা ইতিমধ্যে অনিয়মিত পথে ইউরোপে অবস্থান করেছেন, তাঁদের কথার ভিত্তিতে এই চক্রের সঙ্গে মধ্যস্থতা স্থাপন করে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে পরে যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৮ শতাংশ এই চক্রের কথা নিশ্চিত করেছেন।

অভিবাসন ব্যয়

যাত্রাপথের ওপর ভিত্তি করে অভিবাসন ব্যয় একেক সময় একেক রকম হয়ে থাকে। স্থলপথে যাত্রা করলে ৮ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার খরচ হয় বলে বাংলাদেশি অভিবাসীরা নিশ্চিত করেছেন। যদি ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে চান, সে ক্ষেত্রে তুরস্ক, গ্রিস ও স্পেনের উপকূলবর্তী এলাকা দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।

প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই বা তুরস্ক হয়ে লিবিয়া যাওয়ার জন্য স্থানীয় দালালদের প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার দিতে হয় বলে অভিবাসীরা দাবি করেছেন। এরপর সমুদ্রপথে যাত্রার জন্য তাঁদের অতিরিক্ত ৭০০ থেকে ১ হাজার ডলার খরচ করতে হয়। দাবি অনুযায়ী, বছরখানেক আগে অর্থ দেওয়ার পরও নিজেদের কাছে থাকা সঞ্চিত অর্থ না দেওয়ায় ১৩ জন বাংলাদেশি অভিবাসী স্থানীয় দালাল ও পাচারকারীদের হাতে চরম নিগ্রহের শিকার হন। তাঁদের নৌকায় উঠতে বাধা দেওয়া হয়। পরে আইএমওর সহযোগিতায় তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা জানা সত্ত্বেও অনেকেই স্থায়ী নাগরিকত্ব ও উন্নত জীবনের আশায় এই পথ পাড়ি দেন। তাঁদের মতে, ইউরোপে একবার প্রবেশ করতে পারলেই স্থায়ী নাগরিকত্ব সময়ের ব্যাপারমাত্র। এতে তাঁদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়বে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। অস্ট্রিয়ায় অবস্থানরত ২৬ বছর বয়সী ইকবাল (ছদ্মনাম) ধনী পরিবারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপে পাড়ি জমান শুধু পরিবারে নিজের সম্মান বাড়ানোর জন্য। জার্মানিতে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনের কথায় তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আইনি জটিলতার কারণে অস্ট্রিয়ার সরকার তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে পরিবারে আগের মতো গুরুত্ব পাবেন কি না, তা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত।

আরও পড়ুন

দেশে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় তরুণদের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। তরুণ সমাজ যদি দেশে অনিরাপদ বোধ করে, সহিংসতার শিকার হয় ও দেশে অনিশ্চিত জীবনের শঙ্কা দেখে, তবে তারা দেশ ছাড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। গ্রিসে আটকা পড়া ২৯ বছর বয়সী হাফিজুর রহমানের (ছদ্মনাম) মতে, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত।

পড়াশোনার পেছনে বিপুল অর্থ আর সময় খরচের পর চাকরিতে যে বেতন দেওয়া হয়, তা অপর্যাপ্ত। তাঁর মতো অনেক শিক্ষিত তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে এই রাস্তা বেছে নেন। কম ঝুঁকিপূর্ণ ও নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা দালালদের মোটা অঙ্কের টাকা প্রদান করেন। দিন শেষে তাঁরাও প্রতারণার শিকার হন।

তরুণদের মধ্যে নতুন নতুন দিক আবিষ্কারের নেশা প্রবল, অনেকেই এই জন্য বিশ্বভ্রমণে বের হন। তাঁদের জন্য অভিবাসন আর্থিক সচ্ছলতা বা উন্নত জীবনের হাতিয়ার নয়, বরং নতুন পরিবেশ নিয়ে জানার মাধ্যম ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তবে বাংলাদেশি তরুণ সমাজের মধ্যে কৌতূহল থেকে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সংখ্যা কম নয়। কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ২১ বছর বয়সী ছাত্র রাহাত ও ফারদিন (ছদ্মনাম) অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন শুধু এই ঝুঁকির অভিজ্ঞতা লাভের আশায়। তাঁদের মতে, এই বয়সই জীবনে ঝুঁকি নেওয়ার সঠিক সময়। তাই ছুটিতে গ্রামে আসার পর তাঁরা স্থানীয় দালালদের শরণাপন্ন হন।

সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার

প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে করেছে সুন্দর, আরেক দিকে এর অপব্যবহার আমাদের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। বর্তমানে ফেসবুক, ইমো, ইউটিউবের মতো গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবহার করে ইউরোপে বসবাসরত বাংলাদেশিরা কীভাবে তাঁদের মাধ্যমে উপকার পেয়েছেন এবং কী রকম উন্নত জীবনযাপন করছেন, তা পাচারকারীরা নিজেদের বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করছেন।

আইএমওর গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে পাচারকারীরা সফল সীমান্ত পারাপারের ভিডিও বিভিন্নভাবে চিত্রিত করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। প্রায় ৫৮ শতাংশ অভিবাসী স্বীকার করেছেন, কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়ে ইউরোপে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৩৮ বছর বয়সী শফিকুল ইসলাম প্রতারণার শিকার হয়ে এখন সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। ফেসবুকে একজনের সঙ্গে যোগাযোগের পর তিনি জার্মানিতে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে তাঁর সেই ফেসবুক বন্ধু ইউটিউবের ভিডিও দেখিয়ে তাঁকে অবৈধ পথে আসার পরামর্শ দেন এবং তাঁর কাছে প্রায় ৬ হাজার ডলার দাবি করেন। শফিকুল ইসলাম তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে তুরস্ক ও কসোভো হয়ে ইউরোপে ঢোকার একাধিকবার চেষ্টা করেন।

আরও পড়ুন

অভিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়াও দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা কেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছেন, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব দালাল লিবিয়া, তুরস্ক, দুবাইয়ের ট্রানজিট পয়েন্টে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনে সেসব দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

দেশেই যে মর্যাদার সঙ্গে কর্মসংস্থান সম্ভব, সে বিষয়ে তরুণ সমাজের আস্থা অর্জন যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে। যাঁরা দেশের বাইরে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁরা যেন আইনগতভাবে যেতে পারেন, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বৈধভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে গেলে বিদেশে যেমন সম্মানজনক ভালো বেতনের সুযোগ আছে, তেমনি নিজের জীবনেরও নিরাপত্তা থাকবে—এ বিষয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বোঝাতে হবে।

পরিশেষে, সরকার থেকে শুরু করে সবাইকে অভিবাসীদের শুধু প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠানোর হাতিয়ার হিসেবে নয়, তাদের সম্মান দেখাতে হবে। তাদেরও আর সবার মতো সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে, আর এই অধিকার রক্ষায় সরকারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।

  •  জালাল উদ্দিন শিকদারসেলিম রেজা, শিক্ষক ও সদস্য, সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

  • কে এম নূর-ই-জান্নাত নদী, গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।