ল্যুভর জাদুঘরে শ্রমিকের বেশে ঢুকে ৪ মিনিটেই কাজ সেরে ফেলে চোরের দল

চুরির পর ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে একটি মই দাঁড় করানো আছেছবি: এএফপি

প্রথমে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর ‘বিশেষ কারণে’ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর জানা যায়, সেখানে ঘটে গেছে দুর্ধর্ষ এক চুরির ঘটনা। চোরের দল এত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে চুরি করেছে যে কারও কারও কাছে এটিকে হলিউডের সিনেমার গল্প মনে হয়েছে।

গতকাল রোববার একটি ভাঁজ করা মই ব্যবহার করে এক দল চোর জানালা ভেঙে ল্যুভর জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা জাদুঘরের অ্যাপোলো গ্যালারি থেকে আটটি মূল্যবান রত্নালংকার চুরি করে মোটরবাইকে করে পালিয়ে যায়।

দুর্ধর্ষ এই চুরির ঘটনা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ এই জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

ফরাসি কর্তৃপক্ষ বলেছে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, মোটরসাইকেল ও দারুণ দক্ষতার মিশেলে চোরের দল দুর্ধর্ষ এই চুরিতে সফল হয়েছে।

চোরের দলকে ধরতে রোববার প্যারিসজুড়ে অভিযান চালানো হয়েছে। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ল্যুভর জাদুঘরটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে।

ফ্রান্স সরকার ও জাদুঘরের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোববার জাদুঘর খোলার কিছুক্ষণ পরই কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী একটি জানালার ভেতর দিয়ে অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঢোকেন। এ জন্য তাঁরা আসবাব তোলার একটি মই ব্যবহার করেন।

মাত্র চার মিনিটের মধ্যে চোরের দল জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করে নেপোলিয়ন যুগের আটটি মূল্যবান রত্নালংকার নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পথে তারা আরেকটি মূল্যবান অলংকার ফেলে রেখে যায়।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ চুরির এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘যে ঐতিহ্যকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই, এটি তার ওপর একটি আক্রমণ।’

ফরেনসিক দলের একজন সদস্য ল্যুভর জাদুঘরের একটি জানালা পরিদর্শন করছেন। এই জানালা ভেঙেই চোর জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বলে ধারণা করা হচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন মাখোঁ। তিনি বলেছেন, ‘এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্যারিস প্রসিকিউটর দপ্তরের নেতৃত্বে সব জায়গায় সবকিছুই করা হচ্ছে।’

রোববারের এই চুরির ঘটনা আবারও ল্যুভর জাদুঘরে দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত ভিড় এবং সে ভিড় সামলাতে বাড়তি কাজের চাপে পড়া কর্মীদের দুরবস্থাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এ চুরির বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা জানা গেল, তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।

কী ঘটেছে

স্থানীয় সময় রোববার সকাল প্রায় সাড়ে ৯টা। এরই মধ্যে ল্যুভর জাদুঘরে পর্যটকদের ভিড় জমে উঠেছে। দর্শনার্থীরা জাদুঘরের বিভিন্ন হল ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এদিকে চোরের দল অ্যাপোলো গ্যালারির দিকে লক্ষ্য স্থির করে রেখেছে, যেখানে ফরাসি রাজপরিবারের রত্ন সংরক্ষিত আছে।

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা নুনেজ এ ঘটনাকে ‘দুর্ধর্ষ চুরি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, চোরের দল জাদুঘরের জানালার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি ভাঁজ করা মই ব্যবহার করে। তারা মই দিয়ে গ্যালারিতে প্রবেশ করে এবং ‘অমূল্য রত্ন’ নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় টিএফ১ নিউজকে বলেন, সে সময় তিনি কাছাকাছি সাইকেল চালাচ্ছিলেন। তিনি দেখেছেন দুজন ব্যক্তি মইয়ে করে ওপরে উঠে জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। এই পুরো কাজে তাঁরা মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন।

এ ঘটনার পর ল্যুভর জাদুঘর থেকে সব দর্শনার্থীকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং অনলাইনে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলা হয়, ‘বিশেষ’ পরিস্থিতির কারণে জাদুঘর সারা দিন বন্ধ থাকবে।

পুলিশ জাদুঘরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে পুরো জাদুঘর প্রাঙ্গণ খালি করে ফেলে। এমনকি, সিন নদীর পাশের সড়কগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এক মার্কিন পর্যটক সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, এটা ছিল মাথা নষ্ট করা এক ঘটনা। অনেকটা হলিউডের সিনেমার মতো।

এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। ধারণা করা হচ্ছে, চোরের দলে চারজন ছিলেন। স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত চোর বা চুরি যাওয়া অমূল্য বস্তু—কারও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

সম্রাজ্ঞী উজিনির মুকুট। চোরেরা এটি চুরি করার চেষ্টা করেছিল। ছবিটি ২০২০ সালে জাদুঘরের ভেতরে তোলা
ছবি: এএফপি

কী কী চুরি গেছে

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রোববার সন্ধ্যায় নিশ্চিত করে বলা হয়, চোরেরা দুটি উচ্চ-নিরাপত্তাযুক্ত প্রদর্শনী কেস থেকে আটটি বহুমূল্য রত্নালংকার চুরি করে নিয়ে যেতে সফল হয়েছে।

চুরি যাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফরাসি সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মেরি-লুইজের ব্যবহার করা কয়েকটি অলংকার, বাকি মূল্যবান বস্তুগুলো নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী উজিনির।

এটি কোনো মাস্টারপিস চুরির মতো নয়, যেখানে সংবাদমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে সেটির ছবিটি প্রকাশ করবে। এ ধরনের বস্তুগুলো হয়তো টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হবে এবং তারপর পৃথক রত্ন হিসেবে বিক্রি করা হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেগুলো চেনাও সম্ভব হবে না।

চুরি যাওয়া অলংকারগুলো হলো—সম্রাজ্ঞী মেরি-অ্যামেলি এবং সম্রাজ্ঞী হরটেন্সের অলংকার সেটের টিয়ারা এবং নীলমণি বসানো কণ্ঠহার। নীলমণি বসানো একটি অলংকার সেটের একটি কানের দুল, রানি মেরি-লুইজের অলংকার সেটের পান্না বসানো কণ্ঠহার, তাঁর পান্না বসানো এক জোড়া কানের দুল, ‘রিলিকোয়ারি’ নামে পরিচিত একটি মহামূল্যবান ব্রোচ এবং সম্রাজ্ঞী উজিনির টিয়ারা ও বড় একটি ব্রোচ।

তবে জাদুঘরের বাইরের দেয়ালের কাছে পড়ে থাকা অবস্থায় সম্রাজ্ঞী উজিনির মুকুট পাওয়া গেছে।

খুব সম্ভবত পালিয়ে যাওয়ার সময় চোরের দল সেটি ফেলে রেখে যায়। সেটিতে ১ হাজার ৩৫৪টি হীরা ও ৫৬টি পান্না রয়েছে। চুরির সময় সেটির ক্ষতি হয়েছে।

মূল্যবান শিল্পকর্ম চুরি বিশেষজ্ঞ এবং ‘স্টিলিং রেমব্রান্টস: দ্য আনটোল্ড স্টোরিজ অব নটোরিয়াস আর্ট হিস্টস’ বইয়ের সহলেখক অ্যান্থনি আমোরে আল–জাজিরাকে বলেন, এসব বস্তু শুধু অর্থের দিক দিয়েই মূল্যবান নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও অমূল্য।

অ্যান্থনি আমোরে বলেন, ‘এটি কোনো মাস্টারপিস চুরির মতো নয়, যেখানে সংবাদমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে সেটির ছবিটি প্রকাশ করবে। এ ধরনের বস্তুগুলো হয়তো টুকরা টুকরা করে ভেঙে ফেলা হবে এবং তারপর পৃথক রত্ন হিসেবে বিক্রি করা হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেগুলো চেনাও সম্ভব হবে না।’

আরও পড়ুন

কীভাবে চোরেরা চুরি করল

কর্তৃপক্ষ বলেছে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, মোটরসাইকেল ও দারুণ দক্ষতার মিশেলে চোরের দল দুর্ধর্ষ এই চুরিতে সফল হয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, চোরের দলটি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার নিয়ে একটি স্কুটারে চড়ে ল্যুভর জাদুঘর প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। চোরেরা ভাঁজ করা যায় এমন একটি মই ব্যবহার করে বাইরের দিকে থেকে গ্যালারিতে ঢোকে এবং ডিস্ক কাটার দিয়ে জানালার কাচ কেটে ভেতরে প্রবেশ করে।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় টিএফ১ নিউজকে বলেন, সে সময় তিনি কাছাকাছি সাইকেল চালাচ্ছিলেন। তিনি দেখেছেন দুজন ব্যক্তি মইয়ে বেয়ে ওপরে উঠে জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করছেন। এই পুরো কাজে তাঁরা মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন।

ফরাসি আরেকটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, চোরের দল একটি পুরোনো প্রাসাদের ভেতরে অবস্থিত ওই জাদুঘরে প্রবেশ করে। প্রাসাদটি সিন নদীর দিকে মুখ করা। সেখানে সংস্কারকাজ চলছিল।

১৯১১ সালে ল্যুভর জাদুঘর থেকে ‘মোনালিসা’ চুরি গিয়েছিল
ছবি: এএফপি

ওই পত্রিকায় আরও বলা হয়, দুই চোর নির্মাণশ্রমিকদের মতো হলুদ রঙের ভেস্ট পরে ছিলেন।

সংস্কৃতিমন্ত্রী রাশিদা দাতি বলেন, চুরির তথ্য পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত হয়।

এই মন্ত্রী আরও বলেন, ‘সত্যি বলতে, মাত্র চার মিনিটের মধ্যে চোরের দল এই কাজ করেছে। সবকিছু হয়েছিল খুবই দ্রুত।’

চুরির পর ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে একটি ভাঁজ করা মই দাঁড়িয়ে আছে। মইটি যেখানে রাখা, সেখান দিয়েই চোরের দল ভবনে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হয়। পরে মইটি সরিয়ে নেওয়া হয়।

এটা ছিল মাথা নষ্ট করা। অনেকটা হলিউডের সিনেমার মতো।—এক মার্কিন পর্যটক

এখন কী হবে

চোরের দল এখনো ধরা পড়েনি। প্রমাণ সংগ্রহ করতে ফরেনসিক দলগুলো ল্যুভর জাদুঘর ও আশপাশের সড়কগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলোতে সন্দেহজনক কিছু আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

রোববার ঘটনার সময় যেসব কর্মী জাদুঘরে দায়িত্বরত ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে আলাদাভাবে ঘটনার বিবরণ নেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

সংস্কৃতিমন্ত্রী রাশিদা দাতি বলেন, চোরেরা পেশাদার ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আজকাল সংঘবদ্ধ অপরাধীরা শিল্পকর্মকে নিশানা বানাচ্ছে এবং জাদুঘরগুলো অবশ্যই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে।’

শত বছরের বেশি সময় আগে ল্যুভরে সাড়া জাগানো এক চুরির ঘটনা ঘটেছিল। ১৯১১ সালে জাদুঘরটি থেকে ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্ম লোপাট করা হয়। দুই বছর পর ১৯১৩ সালে ইতালির একটি হোটেল থেকে সেটি উদ্ধার হয়। পরে আবার মোনালিসাকে ল্যুভরে ফিরিয়ে আনা হয়।

গত কয়েক বছরে ল্যুভর জাদুঘরে দর্শনার্থীর ভিড় অনেক বেড়েছে। গত বছর প্রায় ৮৭ লাখ মানুষ ল্যুভর জাদুঘর দেখতে গেছেন। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপ সামলাতে কর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

গত জুনে কর্মীরা ধর্মঘট ডেকেছিলেন। কাজের চাপ কমাতে তাঁরা নতুন কর্মী নিয়োগের দাবিতে ওই ধর্মঘট করেছিলেন।

রোববার দিনের আলোয় এমন দুর্ধর্ষ চুরি ফ্রান্সের নাগরিক ও রাজনীতিকদের উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। কেউ কেউ এত বিখ্যাত একটি জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন