স্ত্রীর কণ্ঠস্বর যেভাবে কোমা থেকে ফেরাল স্বামীকে

স্ত্রী ভ্যালেরিয়ার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি ও পা হারানো ইউক্রেনীয় সেনা সেরহিছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন সেরহি। যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে কোমায় ছিলেন। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরতে পেতে শুরু করলে তিনি বুঝতে পারেন—চারদিক অন্ধকার, দৃষ্টিশক্তি নেই। শুধু তা–ই নয়, কথাও বলতে পারছেন না এবং পায়ের অস্তিত্বও অনুভব করতে পারছেন না। তবে শুধু তাঁর স্ত্রী ভ্যালেরিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। এই কণ্ঠস্বর শুনে তিনি আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

এভাবে এক সপ্তাহ ধরে স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনে চেতনা ফিরে আবারও চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছিল। এরপর স্থায়ীভাবে সেরহির চেতনা ফিরে আসে। ২৭ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় এই সেনা যুদ্ধে গুরুতর আহত হন। চেতনা হারিয়ে ফেলেন তিনি।

হাসপাতালে কোমায় থাকার কারণে সেরহির গলার নিচে টিউব লাগানো হয়। এ কারণে কারও সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেন না তিনি। সাড়া নেই কোনো। কিন্তু প্রতিবারই স্ত্রী ভ্যালেরিয়ার ডাক শুনতে পান তিনি। যতবারই এই ডাক শুনতে পান, ততবার তিনি স্থির হয়ে যান। মূলত স্ত্রীর এই কণ্ঠস্বরই তাঁর চেতনা ফিরে পেতে সহযোগিতা করেছে।

বিবিসির ইউক্রেনকাস্ট পডকাস্টে সেরহি বলেন, ‘এটাই আমাকে লড়াই করতে সহযোগিতা দিয়েছে।’

সেরহি বলেন, ‘আমি শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছি। যে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নগুলো আমি দেখেছি, তাতে আমাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ধ্বংস করা হচ্ছে, চিবানো হচ্ছে। এরপর চেতনা ফিরে আসে শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে...কারণ আমি তাঁর কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে থেকেই লড়াই করতে হবে।’

রাশিয়া ইউক্রেনের হামলা শুরুর ৯ মাস পর দেশটির মারিঙ্কার কাছে রাশিয়ান ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হন সেরহি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই সেরহিকে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। প্রায়ই তাঁকে ভ্যালেরিয়ার সঙ্গে কথা না বলেই কয়েক সপ্তাহের জন্য চলে যেতে হয়েছিল। ভ্যালেরিয়া নিজ শহর কিয়েভে থেকে গিয়েছিলেন।

২০২২ সালের নভেম্বরে যখন সেরহির গাড়ি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরণে আহত হন, তখন তাঁর সঙ্গে আরও সাত সেনা ছিলেন। বিস্ফোরণে তাঁর মেরুদণ্ড, শ্রোণি, নাক, চোখের সকেট ভেঙে যায়। মাথার খুলি ভেঙে মস্তিষ্কে আঘাত লাগে। তাঁর মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়, ঊরু ভেঙে যায় এবং তাঁর পা দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবু প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এর পর থেকে স্ত্রী ভ্যালেরিয়া ছাড়া তিনি আর কিছু মনে করতে পারেন না।

আরও পড়ুন

ভ্যালেরিয়া বলেন, ‘তিনি যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুই পা নিয়ে ফিরে আসবে, এটা আমি প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু যখন প্রথম তাঁকে দেখলাম, তখন তাঁর ক্ষতের ভয়াবহতার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।’

সেরহির স্ত্রী আরও বলেন, ‘তবু আমার স্বস্তি ছিল যে তিনি বেঁচে আছেন। কারণ, যে অবস্থা ছিল, তাতে নিশ্চিত ছিলাম, তাঁর চেতনা আর কখনোই ফিরবে না। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, তাঁর সারা শরীরে টিউব লাগানো। কোনো চেতনা নেই। এটি ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য।’

টানা ২০ দিন কোমায় থাকার পর চেতনা ফিরে পান সেরহি। এরপর আরও এক সপ্তাহ তাঁকে নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে হয়। আরও দুই সপ্তাহ ট্রমাটিক ইনজুরি ইউনিটে এবং এরপর কয়েক মাস পুনর্বাসনে থাকতে হয়েছে তাঁকে।

এই বেশ আছেন সেরহি। এই দুর্ঘটনা তিনি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। তাঁর মতে, একটি হাত হারানোর চেয়ে দুটি পা হারানো ভালো। ডেন্টিস্ট স্ত্রী ভ্যালেরিয়াও একইভাবে বাস্তববাদী হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন দৃষ্টিহীন ও পা হীন স্বামী অতটা খারাপ নয়। তবে সে যে দাঁত হারায়নি, এটাই স্বস্তির।’

আরও পড়ুন

গত সপ্তাহে সেরহির একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ফেরানোর আশায় যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে জানানো হয়, এটি আর সম্ভব নয়। তিনি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এতে এই দম্পতি হতাশ হলেও তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী। সেরহি তাঁর জীবনের বাকি সময়টা তাঁর সহকর্মী আহত সেনাদের পক্ষে কাজ করতে করতে চান।

সেরহি বলেন, ‘আমার অনেক পরিকল্পনা আছে। একটি জীবনকাল এর জন্য যথেষ্ট নয়। আমি অবশ্যই ইউক্রেনে ফিরে যাব। ওটা আমার দেশ। আমি এর জন্য লড়াই করেছি। এর জন্য আমি [আমার] ক্ষতগুলো ধরে রেখেছি।’

সেরহি দুটি সংস্থা চালু করার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য, আহত প্রবীণদের সাহায্য করা এবং যুদ্ধের পর তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য অবকাঠামো তৈরি করা।

ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশই হতাহত সেনাদের সংখ্যা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা নিউইয়র্ক টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই যুদ্ধে ৭০ হাজার নিহত ও ১ লাখ ২০ হাজার জন আহত হয়েছেন।

এই দুর্ঘটনা মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আনেনি বলে জানিয়েছেন সেরহি। কিন্তু ভ্যালেরিয়া এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। ভ্যালেরিয়া বলেন, ‘তিনি আরও দায়িত্বশীল হয়েছেন। আগেও দায়িত্বশীল ছিলেন। কিন্তু তা ছিল নিজের পরিবার ও সামরিক ইউনিটের প্রতি। কিন্তু এখন তিনি পুরো দেশের জন্য চিন্তা করছেন।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন