‘নৃশংস’ মার্কিন ব্ল্যাকওয়াটারই ভাগনার সৃষ্টির পথ দেখিয়েছে

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সুবাদে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী ভাগনার গ্রুপ বিশ্বব্যাপী আলোচিত। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু ভাগনারই নয়, আরও নানা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকওয়াটার, যারা ২০০৭ সালে ইরাকের বাগদাদে ১৪ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ করা এই বাহিনীই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পথ দেখিয়েছে বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইব্রাহিম আল–মারাশি। এ নিয়ে আল–জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখাটি বাংলা করা হলো।

ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী বাহিনী ব্ল্যাকওয়াটারের যোদ্ধারা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ভাগনারের বিদ্রোহের পর অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা ছিল, বাহিনীটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনকে এর চড়া মূল্য দিতে হবে। এমনকি তাঁর জীবন নেওয়া হতে পারে। তবে তেমন কিছু হয়নি। বিদ্রোহের পর প্রিগোশিনকে প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে ‘নির্বাসনে’ পাঠানো হয়। আর তাঁর যোদ্ধারা বিভিন্ন দেশে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এমনকি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন প্রিগোশিন। এরপর তিনি ঘোষণা দেন, ভাগনার শুধু আফ্রিকায় কার্যক্রম চালাবে।

ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় পুতিনের চাওয়া–পাওয়া বাস্তবায়নে নিজেদের অনেকটা যোগ্য প্রমাণ করেছে ভাগনার। তাই এই বাহিনী তিনি জিইয়ে রাখতে চাইবেন—তা মোটেও অবাক করার মতো নয়। সম্ভবত তিনি এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দু–একটি শিক্ষা নিয়েছেন। ভাড়াটে যোদ্ধাদের ওপর মার্কিনিদের বড় নির্ভরশীলতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি অনেক দেশই এখন যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা নামানোর পথে হাঁটছে। এর কিছু সুবিধা আছে। যেমন যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহারের মাধ্যমে দায় এড়ানোর সুযোগ থাকে। আর বিদেশে চলমান যুদ্ধ ঘিরে দেশের অভ্যন্তরেও উত্তেজনা কমানো যায়।

ভাড়াটে যোদ্ধার ব্যবহার

যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধাদের কাজে লাগানো যুক্তরাষ্ট্রে জন্য নতুন কোনো কৌশল নয়। বরং দেশটি দুই দশক ধরে এ কার্যক্রম বাড়িয়েছে। এর আগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর ১০ শতাংশ ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা। আর ২০০১ সালে ওয়াশিংটন যে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেছিল, তার প্রায় ৫০ শতাংশ বা তার বেশি সেনা ছিলেন ভাড়া করা। আসলে আফগানিস্তান, ইরাকসহ অন্যান্য জায়গায় যুদ্ধ চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ সেনার দরকার ছিল। তবে এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টি হতে পারে—এমন ভয় থেকে যোদ্ধা ভাড়া নেওয়ার পথে হাঁটে মার্কিন সরকার।

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই অর্থের তিন ভাগের দুই ভাগ থেকে অর্ধেক দিতে হয়েছে চুক্তিতে কাজ করা বিভিন্ন সামরিক বাহিনীকে। এ থেকে বড় একটি অংশ খরচ হয়েছে লজিস্টিক, নির্মাণ ও অস্ত্র সরবরাহসংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তির পেছনে। ভাড়াটে যোদ্ধারাও পেয়েছেন বিপুল অর্থ।

ভাগনার সেনাদের সঙ্গে রাশিয়ার ভাড়াটে এই বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন
ছবি: এএফপি

২০০৮ সালে ইরাকে বিদ্রোহ দমনের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চুক্তিতে কাজ করা ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০। তাঁদের মধ্যে ভাড়াটে যোদ্ধাদের পাশাপাশি যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি, এমন ব্যক্তিও ছিলেন। অথচ ওই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ছিলেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮০০ জন। এ ছাড়া ২০১০ সালে তালেবানবিরোধী যুদ্ধে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির আওতায় লড়াইসহ অন্যান্য কাজ করছিলেন ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ জন। অপর দিকে মার্কিন সেনা ছিলেন ৭৯ হাজার ১০০ জন।

ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পেছনে এভাবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢালার কারণে এই ব্যবসা আরও বড় ও শক্তিশালী হয়েছে। তাদের ব্যবহার করে যুদ্ধ চালিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ থাকে। সেনাদের বিদেশে যুদ্ধ করতে পাঠালে দেশের মানুষের মধ্যে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া কাজ করে। ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সে সমস্যায় ইতি টানা যায়। আরেকটা বড় সুবিধা হলো এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায় সরাসরি নিজেদের ঘাড়ে পড়াটা এড়ানোর সুযোগ পাওয়া যায়।

রাশিয়ার ভূখণ্ড ও ইউক্রেন থেকে ভাগনার যোদ্ধাদের সরিয়ে দিয়েছে ক্রেমলিন। তবে এর বাইরে অন্যান্য দেশে ভাগনারের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। কারণ, সেগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার জন্য খুবই লাভজনক।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০৭ সালে বাগদাদে ১৪ জন বেসামরিক ইরাকিকে হত্যা করে মার্কিন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকওয়াটার। বাহিনীটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর অধীনে ছিল না। ব্ল্যাকওয়াটারকে নিয়োগ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। পরে যখন ইরাক সরকার ব্ল্যাকওয়াটারের সঙ্গে তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে চাইল, দেখা গেল, এমন কোনো লাইসেন্স আদৌ ছিল না। আর ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ইরাকি আইনের আওতায় ছিলেন না। তাই ইরাকের মাটিতে তাঁদের বিচারের সুযোগ ছিল না।

আরও পড়ুন
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রবেশমুখে তৎপর রাশিয়ার সেনারা। শনিবার ভাগনার বাহিনীর মস্কো অভিমুখে অভিযান শুরুর পর সতর্ক অবস্থান নেয় রুশ বাহিনী
ছবি: এএফপি

পরে অবশ্য ২০১৫ সালে ব্ল্যাকওয়াটারের সাবেক ৩ যোদ্ধাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত। আরেকজনকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে মাত্র পাঁচ বছর পর হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাগদাদে ইরাকিদের ওই হত্যাকাণ্ড মার্কিন ভাড়াটে যোদ্ধাদের মাত্র একটি নৃশংসতা ছিল। তাঁদের কর্মকাণ্ড ইরাকিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল। এর জেরে দেশটিতে বিদ্রোহ দমাতে যুক্তরাষ্ট্র যে লড়াই শুরু করেছিল, তা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এটা সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এত কিছুর পরও এখনো যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধাদের কাজে লাগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুন

দায় এড়ানো

ক্রেমলিন সম্ভবত মার্কিন সরকারের ভাড়াটে বাহিনীর ব্যবহার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। কী উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে বোঝাপড়া করেছে। কয়েকজন পর্যবেক্ষকের ভাষ্যমতে, বিদেশে অভিযান চালানোর জন্য পুতিন হয়তো ব্ল্যাকওয়াটারের মতো একটি রুশ ভাড়াটে বাহিনী চেয়েছিলেন। এরপর তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় ব্ল্যাকওয়াটারের মতোই একটি ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তোলেন ইয়েভগেনি প্রিগোশিন।

২০০৭ সালে বাগদাদে ১৪ জন বেসামরিক ইরাকিকে হত্যা করে মার্কিন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকওয়াটার। বাহিনীটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর অধীনে ছিল না। ব্ল্যাকওয়াটারকে নিয়োগ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করতে প্রথম প্রিগোশিনের যোদ্ধাদের কাজে লাগানো হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তাঁদের পাঠানো হয় সিরিয়ায়। বিদ্রোহী জেনারেল খালিফা হাফতারের পক্ষে লড়তে লিবিয়ায়ও পা রাখেন তাঁরা। তবে এসব দেশে ভাগনার যোদ্ধাদের উপস্থিতির বিষয়টি অস্বীকার করেছিল ক্রেমলিন। কারণ, রাশিয়ার আইন অনুযায়ী দেশটিতে ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অবৈধ।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেন পুতিন। এ জন্য বিশাল সেনাবহরের দরকার ছিল, যা রুশ সামরিক বাহিনীর ছিল না। ফলে ভাগনারের যোদ্ধাদের ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। যুদ্ধ নেমে দ্রুতই যোদ্ধাদের হারাতে থাকেন প্রিগোশিন। ঘাটতি পূরণে তিনি রাশিয়ায় কারাবন্দী অপরাধীদের ভাগনারে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। এর বিনিময়ে তাঁদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

এভাবে যুদ্ধে রাশিয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল, তা কমাতে ক্রেমলিনকে সহায়তা করেছে ভাগনার। তবে বাহিনীটি সরাসরি রুশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এটা ক্রেমলিনের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর ভাগনারের বিদ্রোহও পুতিনের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। এটি তাঁকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এমনকি নিজ দেশের নেতাদের কাছে দুর্বল হিসেবে তুলে ধরেছিল। প্রিগোশিনের বিদ্রোহের এই প্রভাব আগামী কয়েক মাস ধরে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়ার ভূখণ্ড ও ইউক্রেন থেকে ভাগনার যোদ্ধাদের সরিয়ে দিয়েছে ক্রেমলিন। তবে এর বাইরে অন্যান্য দেশে ভাগনারের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। কারণ, সেগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার জন্য খুবই লাভজনক। সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিনিময়ে ভাগনার ও বাহিনীটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দেশে তেল–গ্যাস উত্তোলন এবং হীরা ও সোনা খননের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছে। এ থেকে রাশিয়া অর্থিকভাবে লাভবান হয়। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী দিয়ে এসব কাজ করাতে পারবে না মস্কো।

ভাড়াটে যোদ্ধাদের ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অন্য শক্তিগুলো যুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকজনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে আইন, তা এড়িয়ে যাচ্ছে। দেশগুলোর এমন আচরণ ভাড়াটে যোদ্ধাদের সহিংসতা ও নৃশংসতা চালিয়ে যেতে অনুমোদন দিচ্ছে। বলতে গেলে ব্ল্যাকওয়াটার ও ভাগনার আসলে পৃথিবীকে আরও ভয়ংকর একটি স্থানে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন