ট্রাম্প–পুতিন বৈঠক কি যুদ্ধ থামাতে পারবে, ইতিহাস কী বলছে

আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ শহরে শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ছবি: রয়টার্স

আলাস্কায় রাশিয়া ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যকার বৈঠক সমস্যার শেষ নয়; বরং এক দীর্ঘ যাত্রার সূচনামাত্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিরতার সমাধান দিতে পারবে না এই বৈঠক। তবুও এটি সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে, যখন শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতাদের বৈঠক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান দিয়েছে।

এর একটি কারণ হলো, এত বেশি মাত্রায় মনোযোগ আকর্ষণ করা পরিস্থিতিও খুব বিরল। আমরা বর্তমানে ঠিক তেমনই একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, তাদের লক্ষ্য হলো রাশিয়ার ‘কৌশলগত পরাজয়।’ আর রাশিয়া বিশ্বরাজনীতিতে পশ্চিমাদের একচেটিয়া আধিপত্যের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।

অন্য কারণ হলো বাস্তবিক। বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতারা এমন কোনো সমস্যার পেছনে সময় নষ্ট করেন না, যেগুলো তাঁদের অধীনেরাই সমাধান করতে পারেন। আর ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায়, শীর্ষ পর্যায়ের এসব বৈঠকের কারণে কদাচিৎ বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলেছে।

আর তাই আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠককে অতীতের অনেক বিখ্যাত বৈঠকের সঙ্গে তুলনা করা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ইতিহাসে অনেক শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে, যেগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর বদলে পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে।

বিশেষ করে ১৮০৭ সালে নেমন নদীতে একটি ভেলার ওপর অনুষ্ঠিত রাশিয়া ও ফ্রান্সের সম্রাটের মধ্যের বৈঠকের সঙ্গে আলাস্কার বৈঠকের তুলনা করা হচ্ছে। নেমন নদীর ওপর বৈঠকও যুদ্ধ ঠেকাতে পারেনি। বৈঠকের মাত্র পাঁচ বছর পর নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করে বসেন। আর সেই ভুলই তাঁর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এরপর ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসে রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো বড় ক্ষমতাধর দেশের নেতা নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেননি। জার প্রথম আলেকজান্ডার তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ইউরোপের নতুন রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অন্য শক্তিগুলো তা মানেনি। যেমন হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, তাঁরা আদর্শ নয়; বরং স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করতে চাইতেন।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

ইতিহাসে অনেক শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে, যেগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর বদলে পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। ইউরোপে সম্রাটেরা আলোচনায় বসতেন; কিন্তু কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারতেন না। শেষমেশ সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধে নামতেন। যুদ্ধ শেষে আবার তাঁদের দূতেরা আলোচনায় বসতেন। তখন সবাই জানতেন, ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ কথাটার অর্থ আসলে পরবর্তী যুদ্ধের আগ পর্যন্ত একটুখানি বিরতি।

এশিয়ায় অবশ্য ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। চীন কিংবা জাপানের সম্রাটদের মর্যাদা এতটাই অনন্য ছিল যে সমমর্যাদার কারও সঙ্গে বসার সুযোগ ছিল না তাঁদের।

২০২১ সালের জেনেভায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কথাও হয়তো সেভাবেই মনে রাখা হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কয়েক মাস আগে এ বৈঠক হয়। তখন রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গিয়েছিল যে তাদের বিরোধ মিটবে না। এর পরই কিয়েভে অস্ত্র পাঠানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বিপরীতে মস্কোও সামরিক-কৌশলগত প্রস্তুতি বৃদ্ধি করতে থাকে।

রাশিয়ার নিজেদের ইতিহাসেও এমন উদাহরণ আছে। যেমন ৯৭১ সালে প্রিন্স স্বিয়াতোস্লাভ আর বাইজেন্টাইন সম্রাট জন টিজিমিসকেসের মধ্যের বৈঠক। শান্তিচুক্তি করার পর তাঁরা ‘বন্ধু হিসেবে’ একজন আরেকজনকে বিদায় জানিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে বাইজেন্টাইনরা পেচেনেগদের দিয়ে প্রিন্স স্বিয়াতোস্লাভের ওপর হামলা চালায়।

আরও পড়ুন

এশিয়ায় অবশ্য ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। চীন কিংবা জাপানের সম্রাটদের মর্যাদা এতটাই অনন্য ছিল যে সমমর্যাদার কারও সঙ্গে বসার সুযোগ ছিল না তাঁদের। সাংস্কৃতিক ও আইনিভাবেই সেটা ছিল অসম্ভব।

আধুনিক ইউরোপীয় বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল অন্যভাবে। যেমন ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তি। এ চুক্তি ইউরোপে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে ১৬১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। শাসকদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক নয়; বরং শত শত দূতের বছরের পর বছর আলোচনার ফলে এই শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়েছিল। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে সবাই এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ কারণেই তারা চুক্তির শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

ইতিহাসের আলোকে দেখলে বোঝা যায়, এ ধরনের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক খুবই বিরল। আর মৌলিক পরিবর্তন এনেছে, এমন বৈঠকের নজির আরও কম। পুরো দুনিয়ার পক্ষে দুজন নেতার কথা বলার ঐতিহ্য আসলে তৈরি হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে। তখন কেবল মস্কো আর ওয়াশিংটনেরই ছিল ক্ষমতা—বিশ্বকে বাঁচানোর কিংবা ধ্বংস করার ক্ষমতা কেবল তাদের ছিল।

আরও পড়ুন
শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

এমনকি রোমান এবং চীনা সম্রাটেরা যদি তৃতীয় শতকে আলোচনায় বসতেন, তাতেও দুনিয়ার ভাগ্য বদলাত না। তখনকার সাম্রাজ্যগুলো একটি যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো পৃথিবী জয় করতে পারত না; কিন্তু আজ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র তা পারে। গত তিন বছরে দেশ দুটি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। আর তাই বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও আলাস্কার বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ।

এ ধরনের বৈঠক আসলে পারমাণবিক যুগের ফসল। এগুলোকে শুধু একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। আমরা বিপর্যয়ের কতটা কাছে কিংবা দূরে আছি—তারই ইঙ্গিত দেয় এ ধরনের বৈঠক।

যুক্তরাষ্ট্র এ বৈঠকে পশ্চিমা জোটের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এমনকি কৌশলগত প্রশ্নে যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। আর রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার ডজনখানেক দেশ। তারা পশ্চিমাদের আধিপত্যে বিরক্ত; কিন্তু নিজেরা একা সেই আধিপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না। এই দেশগুলো জানে, স্থানীয় সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা আধিপত্যের অন্যায্য কাঠামোকে বদলাতে পারবে না।

তাহলে কি আলাস্কা থেকে নতুন কোনো বিশ্বব্যবস্থা জন্ম নেবে? সম্ভবত না। একটি স্থায়ী বিশ্বব্যবস্থার ধারণা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। কোনো শক্তিই এখন সেটি বজায় রাখার মতো ক্ষমতাধর নয়। তাই বিশ্ব রাজনীতি এগোচ্ছে আরও অনিশ্চয়তার দিকে।

এই বৈঠক থেকে তাৎক্ষণিক সমাধান আসবে না; বরং শুরু হবে দীর্ঘ ও কঠিন আলোচনার পথ। কিন্তু ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যখন পৃথিবীর একমাত্র অজেয় শক্তি দুটি মুখোমুখি হয়, তখন তাদের সরাসরি সংলাপ মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন