ফিরে দেখা
এক ভোরে পোল্যান্ডে হিটলারের আক্রমণ বিশ্বব্যাপী ডেকে এনেছিল বিপর্যয়
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভোররাতে আকস্মিকভাবে পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি জার্মানি। পোল্যান্ড আক্রমণের ৮৬তম বার্ষিকী ছিল গতকাল। প্রথম আলো অনলাইনের ‘ফিরে দেখা’ সিরিজে এ ঘটনা নিয়ে থাকছে প্রতিবেদন।
ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পোল্যান্ডবাসী। ঠিক সে সময় পোল্যান্ডের উত্তর উপকূলের বাল্টিক সাগরের আকাশ আগুনের হলকায় লাল হয়ে ওঠে।
জার্মান যুদ্ধজাহাজ শ্লেসভিগ-হলস্টাইন বাল্টিক সাগর-সংলগ্ন ডানজিগ বন্দরের কাছে অবস্থিত পোলিশ সামরিক ঘাঁটি ওয়েস্টারপ্লাটে গোলাবর্ষণ শুরু করে। একই সঙ্গে জাহাজে অবস্থানরত বিশেষ প্রশিক্ষিত জার্মান নৌ সেনারা পোলিশ উপকূলে হামলে পড়েন।
এভাবেই এক ভোররাতের আকস্মিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিধ্বংসী অধ্যায়—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।
প্রতিশোধস্পৃহা
জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। পরাজিত জার্মানির ওপর বিজয়ী মিত্র শক্তি ১৯১৯ সালের ‘ভার্সাই চুক্তি’ চাপিয়ে দেয়। চুক্তিটির নানা অসম শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় জার্মানি।
এই চুক্তির কঠোর শর্তে জার্মানিকে ভূখণ্ড ছাড়তে হয়। সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশক্তি কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। বিশাল যুদ্ধ–ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে জার্মানি দুর্বল হয়ে পড়ে।
জার্মানরা ভার্সাই চুক্তিকে ‘আরোপিত শান্তিচুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা চুক্তিটিকে জাতীয় অপমান হিসেবে দেখে। ফলে জার্মান সমাজে জন্ম নেয় তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা।
এই প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে আসেন অ্যাডলফ হিটলার। তিনি জার্মান জাতিকে অপমান মোচন, প্রতিশোধ গ্রহণ এবং এক নতুন মহান সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখান।
একনায়কতন্ত্র
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর জার্মান রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে অতি ডানপন্থী ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া হিটলার ১৯১৯ সালে এই দলে যোগ দেন।
১৯২০ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’। দলটি পরে সংক্ষেপে নাৎসি পার্টি নামে পরিচিতি পায়। একই বছর দলের ইশতেহারের ২৫ দফা তুলে ধরেন হিটলার। এসব দফার মধ্যে অন্যতম ছিল ভার্সাই চুক্তি বাতিল করা।
১৯২১ সালে নাৎসি পার্টির নেতা নির্বাচিত হন হিটলার। তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য, প্রচারকৌশল ও সাংগঠনিক দক্ষতায় নাৎসি পার্টি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৩২ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনে পার্লামেন্টে সর্বাধিক আসন পেয়ে নাৎসি পার্টি জার্মানির বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
জার্মানির প্রেসিডেন্ট পল ফন হিন্ডেনবার্গ ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন।
চ্যান্সেলর হওয়ার পর হিটলার প্রথমেই নিজের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৩৩ সালের মার্চে ‘এনাবলিং অ্যাক্ট’ পাসের মাধ্যমে তিনি পার্লামেন্ট ছাড়াই আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করেন। তাঁর ক্ষমতা হয় নিরঙ্কুশ।
১৯৩৪ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারা যান। এরপর হিটলার চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট পদ একীভূত করে নিজেকে ঘোষণা করেন জার্মানির ‘ফুয়েরার’ বা সর্বোচ্চ নেতা। এভাবেই একনায়ক হয়ে ওঠেন হিটলার।
আগ্রাসী নীতি
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার পর হিটলার তাঁর সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য পূরণে পদক্ষেপ নিতে থাকেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জার্মান জনগণের জন্য নতুন ‘বিস্তৃত জীবনীভূমি’ অর্জন। এ জন্য তিনি ভার্সাই চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করতে শুরু করেন।
প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবে হিটলার ১৯৩৬ সালের মার্চে রাইনল্যান্ডে জার্মানির সামরিক নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর পর ১৯৩৮ সালের মার্চে তিনি অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্ত করেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেনল্যান্ড অধিগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালের মার্চে তিনি পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করেন।
এ সময় ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ এড়াতে হিটলারকে বারবার ছাড় দিয়ে যাচ্ছিল, যা ইতিহাসে ‘তুষ্টনীতি’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই নীতি হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবকে আরও উসকে দেয়। তাঁর পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হয় পোল্যান্ড।
নিশানায় পোল্যান্ড
ভার্সাই চুক্তির অধীন জার্মানির ডানজিগ শহর ও আশপাশের এলাকা রাষ্ট্রপুঞ্জের (লিগ অব নেশনস) তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। একই চুক্তির মাধ্যমে পোল্যান্ডকে একটি করিডর (পোলিশ করিডর) দেওয়া হয়েছিল। এই করিডর জার্মানির পূর্ব প্রুশিয়াকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল আর বাল্টিক সাগরে পোল্যান্ডের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছিল।
হিটলার ১৯৩৯ সালের মার্চে ডানজিগের মালিকানা ফেরত চান। পাশাপাশি তিনি পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে পূর্ব প্রুশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরাসরি সড়ক ও রেলপথের দাবি জানান। হিটলারের এই দাবি পোল্যান্ড প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়।
অন্য দেশ দখলের আগে যেমনটা করেছিলেন হিটলার, এবারও তিনি একই ধরনের দাবি করলেন। তিনি অভিযোগ তোলেন, পোল্যান্ডে বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘু জার্মানরা নির্যাতন-নিপীড়ন-অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন।
১৯৩৯ সালের ৩১ আগস্ট রাতে নাৎসি এসএস বাহিনী জার্মানির সীমান্ত শহর গ্লাইভিৎসে এক ভুয়া আক্রমণ পরিচালনা করে। তারা এই আক্রমণকে ‘পোলিশ হামলা’ বলে প্রচার করে। তারা পোলিশ সামরিক পোশাক পরে শহরটির একটি রেডিও স্টেশন দখল করে। তারপর পোলিশ ভাষায় নাৎসিবিরোধী বার্তা প্রচার করে।
এমনকি নাৎসি জার্মানির দাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কয়েকজন বন্দীকে পোলিশ সেনার পোশাক পরিয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যেন মনে হয়, তাঁরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত পোলিশ সেনা।
কিন্তু বাস্তবে এমন আক্রমণ পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে হয়নি। সবকিছুই ছিল নাৎসিদের অপপ্রচার ও যুদ্ধের অজুহাত তৈরির সাজানো নাটক।
গোপন প্রটোকল
১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মকালজুড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে একটি ত্রিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা জোট গঠনের জন্য আলোচনা চালায়। কিন্তু আলোচনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন শর্ত দেয়, যুদ্ধ বাধলে তাদের সেনাদের পোল্যান্ডের ভেতরে প্রবেশ করতে দিতে হবে।
পোল্যান্ড এই শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়। সে সময় পোলিশ সর্বাধিনায়ক এডওয়ার্ড রিজ-শ্মিগ্লি মন্তব্য করেছিলেন, ‘জার্মানদের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে আর সোভিয়েতদের সঙ্গে আমরা হারাব আমাদের আত্মা।’
ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিন্ন পথে হাঁটে। তারা জার্মানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট সোভিয়েত-জার্মান একটি অনাক্রমণ চুক্তি হয়। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়াচেস্লাভ মলটভ ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োয়াখিম ফন রিবেনট্রপ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এ কারণে এটি ‘মলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি’ নামে পরিচিত।
চুক্তিতে একটি গোপন প্রটোকল ছিল, যাতে পোল্যান্ডকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এই চুক্তির ফলে হিটলার নিশ্চিত হন, পোল্যান্ড আক্রমণের পর সোভিয়েতরা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে না। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তি (ব্রিটেন ও ফ্রান্স) প্রতিবাদ জানালেও তারা সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে দেরি করবে বলে ধারণা করছিলেন হিটলার।
সোভিয়েত হস্তক্ষেপের আশঙ্কা কেটে যাওয়ায় হিটলার আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কেননা পোল্যান্ড আক্রমণে তাঁর সামনে আর কোনো বড় বাধা ছিল না।
১৯৩৯ সালের ২২ আগস্ট হিটলার তাঁর জেনারেলদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনৈতিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি, এখন সেনাদের জন্য পথ একেবারেই খোলা।’
যদিও ব্রিটেন ও ফ্রান্স আগেই পোল্যান্ডকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু নাৎসি নেতৃত্বের অনেকে, বিশেষত পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ মনে করতেন, ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি হবে। এসব দেশ শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবে, জার্মানির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না।
পোল্যান্ড আক্রমণ
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভোররাত ৪টা ৪৫ মিনিট। কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই জার্মান যুদ্ধজাহাজ শ্লেসভিগ-হলস্টাইন বাল্টিক উপকূলে অবস্থিত পোলিশ সামরিক ঘাঁটি ওয়েস্টারপ্লাটে গোলাবর্ষণ শুরু করে।
গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে অবস্থানরত বিশেষ প্রশিক্ষিত জার্মান নৌ সেনারা (মেরিন) উপকূলে অবতরণ করে স্থল আক্রমণ চালান। একই সময়ে জার্মান বিমানবাহিনী ও স্থল বাহিনী পোল্যান্ডের বিভিন্ন সীমান্তে সমন্বিত হামলা শুরু করে।
পোল্যান্ড আক্রমণে নাৎসি বাহিনী ‘ব্লিৎসক্রিগ’ বা বজ্রগতির যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে। অর্থাৎ তারা স্থল, নৌ ও আকাশপথে একযোগে বজ্রগতিতে আক্রমণ চালায়।
জার্মান প্যানজার ডিভিশনের ট্যাংকবহর দ্রুতগতিতে সীমান্ত ভেদ করে পোল্যান্ডে প্রবেশ করে। ট্যাংকবহরের পেছনে অগ্রসর হন পদাতিক সেনারা।
জার্মান বিমানবাহিনী একযোগে পোলিশ বিমানঘাঁটি, যোগাযোগব্যবস্থা ও বড় শহরগুলোতে বোমাবর্ষণ করে। কাটোভিৎস, ক্রাকভ, রাজধানী ওয়ারশসহ বিভিন্ন শহর বোমার অগ্নিকুণ্ডে জ্বলে ওঠে। এমনকি যাত্রীবাহী ট্রেনও হামলা থেকে রেহাই পায়নি।
অন্যদিকে জার্মান নৌবাহিনী পোল্যান্ডের বন্দর, উপকূল, সরবরাহ পথের পাশাপাশি পোলিশ নৌবাহিনীকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়।
এই সমন্বিত আক্রমণে প্রায় ১৫ লাখ জার্মান সেনা পোল্যান্ডে প্রবেশ করেন। অন্যদিকে প্রায় ১০ লাখ সদস্যবিশিষ্ট পোলিশ সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্র ও সমন্বিত কৌশলের অভাবে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
আক্রমণের পরপরই হিটলার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি দাবি করেন, আগের রাতে পোলিশ সেনারা জার্মান ভূখণ্ডে (গ্লাইভিৎসের সাজানো ঘটনা) আক্রমণ চালিয়েছে। আর তার জবাবে আত্মরক্ষার্থে তিনি এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
১ সেপ্টেম্বর রাইখস্ট্যাগে দেওয়া ভাষণে হিটলার তাঁর সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ‘পোলিশ রাষ্ট্র আমার শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এই উন্মত্ততার ইতি টানতে এখন আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। বলপ্রয়োগের জবাব আমাকে বলপ্রয়োগ দিয়েই দিতে হবে।’
নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ডে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়। নির্বিচার বেসামরিক মানুষ হত্যা করে তারা। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সংঘটিত হলোকস্টের বিভীষিকার পূর্বসূচনা।
ব্রিটেন-ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণা
হিটলার ভেবেছিলেন, আগের মতো এবারও ব্রিটেন ও ফ্রান্স সরাসরি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেবে না। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। উভয় দেশ জার্মানিকে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা পাঠায়। অবিলম্বে পোল্যান্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে, নইলে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে।
শেষ আলটিমেটাম পাওয়ার পর হিটলার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন। তারপর বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তিনি তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপকে প্রশ্ন করেন, ‘এখন কী হবে?’
আলটিমেটামে জার্মানি সাড়া না দিলে ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রথমে ব্রিটেন, পরে ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপজুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
তবে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও জার্মানির অগ্রযাত্রা থামাতে কার্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ফলে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জার্মান বাহিনী ওয়ারশের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়।
ব্রিটেন তখনো বৃহৎ সামরিক অভিযানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। আর ফ্রান্স সীমান্ত বরাবর একটি সীমিত আক্রমণ শুরু করলেও দ্রুত তা থেমে যায়। ফলে জার্মানি অপ্রতিহতভাবে পোল্যান্ডে অগ্রসর হতে থাকে।
সোভিয়েত আক্রমণ
১৯৩৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। মলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির গোপন প্রটোকল অনুযায়ী, এদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব দিক থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের এই আক্রমণ ইউরোপীয় সংঘাতকে দুই ফ্রন্টে রূপান্তরিত করে। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে যুদ্ধ ইউরোপ ছাড়িয়ে এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ পোল্যান্ডের সরকার ও সামরিক নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। হিটলার পোল্যান্ডে বিজয় ঘোষণা করেন। দেশটি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিম পোল্যান্ড জার্মানি দখল করে আর পূর্ব পোল্যান্ড দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ছয় বছর পর ১৯৪৫ সালের মে মাসে নাৎসি বাহিনী পরাজিত হয়। জার্মানির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) প্রায় ছয় কোটি মানুষ প্রাণ হারান, যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। শুধু পোল্যান্ডেই নিহত হন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ।
নাৎসি জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের ৮৬তম বার্ষিকী ছিল গতকাল ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরের ভোররাতের এই আক্রমণ বিশ্বকে শুধু একটি ভয়ংকর মহাযুদ্ধে টেনে নেয়নি, বরং গোটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকেই আমূল পাল্টে দিয়েছিল।
তথ্যসূত্র: হিস্টোরি ডটকম, হলোকস্ট এনসাইক্লোপিডিয়া, ব্রিটানিকা, ন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মিউজিয়াম।