পুতিনের প্রশংসার কৌশলে কি পা দিয়েছেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনরয়টাস ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকটা ছিল যেন এক অসাধারণ নৈপুণ্যের নমুনা। এক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কীভাবে নিজের প্রভাব খাটানোর কৌশল ব্যবহার করে এক আত্মপ্রেমী নেতাকে প্রভাবিত করতে পারেন, তার নমুনা ছিল এটি।

কিয়েভভিত্তিক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল-জাজিরাকে বলেছেন, গত শুক্রবার ট্রাম্প ও পুতিনের বৈঠক দেখে তাঁর এমনটাই মনে হয়েছে। ওই বিশ্লেষক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিশ্লেষক বলেন, ‘পুতিন ট্রাম্পকে ভালোভাবেই সামলেছেন।’ ওই বিশ্লেষক পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত গুপ্তচর হিসেবে পুতিনের কাটানো বছরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। তখন তিনি গুপ্তচরবৃত্তির জন্য লোকজন সংগ্রহ করতেন।

আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আঙ্কোরেজের কাছে এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন ঘাঁটির রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ও পুতিন পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পুতিন তখন বলেন, ‘শুভ সকাল, প্রিয় প্রতিবেশী।’ এর মধ্য দিয়ে আলাস্কা যে ভৌগোলিকভাবে উত্তর-পূর্ব রাশিয়ার খুব কাছে অবস্থিত, তা ইঙ্গিত করেছেন তিনি।

আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আঙ্কোরেজের কাছে এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন ঘাঁটির রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ও পুতিন পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পুতিন তখন বলেন, ‘শুভ সকাল, প্রিয় প্রতিবেশী।’ এর মধ্য দিয়ে আলাস্কা যে ভৌগোলিকভাবে উত্তর-পূর্ব রাশিয়ার খুব কাছে অবস্থিত, তা ইঙ্গিত করেছেন তিনি।

পুতিনকে অভ্যর্থনা জানাতে ট্রাম্প তাঁর জন্য লালগালিচা বিছিয়েছিলেন। তিনি পুতিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এবং তাঁকে প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত গাড়ি ‘দ্য বিস্ট’-এ চড়িয়েছেন। ওই গাড়িতে বসে পুতিনকে আনন্দিত দেখাচ্ছিল।

সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বারবার ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বৈঠক, ইউক্রেন ইস্যু এবং সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির ব্যাপারে প্রায়ই ট্রাম্পের মুখে শোনা কথাগুলো পুতিনের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যেমন পুতিন বলেছেন, তিনিও মনে করেন যে ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হতো না।

পুতিন বলেন, ‘আজ ট্রাম্প বললেন, যদি তিনি তখন প্রেসিডেন্ট হতেন, যুদ্ধ হতো না। আমি নিশ্চিত, এটা সত্য।’

কিয়েভভিত্তিক ওই বিশ্লেষক মনে করেন, পুতিন চতুর প্রশংসা দিয়ে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করেছেন। আর তাতে প্রভাবিত হয়েই ট্রাম্প বলে দিলেন, ‘চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো চুক্তি নেই।’

ট্রাম্প ও পুতিনের আলোচনা সাত ঘণ্টা ধরে হওয়ার কথা ছিল। তবে তা তিন ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে। যৌথ মধ্যাহ্নভোজও হয়নি। বন্ধ দরজার আড়ালে হওয়ায় ওই আলোচনার বিষয়বস্তু যুদ্ধের মধ্যে কেন্দ্রীভূত থাকেনি।

ওই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘পুতিন একজন আত্মপ্রেমী মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য যা লাগে, সবই করেছেন। বারবার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যা বলেছেন তা বারবার তুলে ধরেছেন এবং ট্রাম্পের আগ্রহের বিষয়গুলোর ওপর বারবার জোর দিয়েছেন।’

কিয়েভের এই বিশ্লেষক রাশিয়ার সামরিক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন লিখে থাকেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ইউক্রেন যুদ্ধসংক্রান্ত শুনানিতেও বক্তব্য দিয়েছেন।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে পুতিন আট মিনিট বক্তৃতা করেন। তিনি আলাস্কার ইতিহাস এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ও মার্কিন সেনার একজোট হয়ে কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

বৈঠকের পর পুতিন ট্রাম্পের চেয়ে দ্বিগুণ সময় বক্তব্য দিয়েছেন।

ট্রাম্প বক্তব্য দিয়েছেন মাত্র তিন মিনিট। তিনি বলেন, ‘বৈঠকে আমরা আরও আলোচনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছি।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘অনেক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। বলা যায় বেশির ভাগ বিষয়ে। কিছু বড় বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। তবে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তাই চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো চুক্তি হবে না।’

ট্রাম্প ও পুতিন কেউই সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রশ্ন নিতে রাজি হননি।

ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর পুতিন বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের ওই সংঘাতের মূল সব কারণ দূর করতে হবে। আমরা কয়েকবারই বলেছি, রাশিয়ার সব বৈধ উদ্বেগ বিবেচনা করতে হবে।’

এখানে ‘মূল কারণ’ বলতে পুতিন বুঝিয়েছেন মস্কোর রাজনৈতিক ছায়ার বাইরে ইউক্রেনের অস্তিত্ব এবং তার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা।

আলাস্কায় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে করমর্দন করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রয়টাস ফাইল ছবি

চীনের প্রেক্ষাপট

অবশ্য অন্য একজন ইউক্রেনীয় পর্যবেক্ষক বলেছেন, এই আলোচনা পুতিনের জন্য পুরোপুরি সফল ছিল না।

ট্রাম্প ও পুতিনের আলোচনা সাত ঘণ্টা ধরে হওয়ার কথা ছিল। তবে তা তিন ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে। যৌথ মধ্যাহ্নভোজও হয়নি। বন্ধ দরজার আড়ালে হওয়ায় ওই আলোচনার বিষয়বস্তু যুদ্ধের মধ্যে কেন্দ্রীভূত থাকেনি।

কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ইগার টাইশকেভিচ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘রাশিয়া অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করছে, তারা ট্রাম্পকে তাৎক্ষণিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও দর-কষাকষি করছে। এর ভিত্তিতে ক্রেমলিন এমন রাজনৈতিক সুবিধা চাইছে, যা ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। আর ইউক্রেন এই পুরো প্রক্রিয়ার একটি অংশ মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ ক্ষেত্রে দেশটির ভূমিকা পার্শ্বচরিত্রের মতো।’

টাইশকেভিচ বলেন, হোয়াইট হাউস চায় না মস্কো ও বেইজিংয়ের স্বার্থ মিলে যাক। ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা ও রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাকে লাভজনক মনে করছেন। আর তাই রাশিয়াকে পুরোপুরি পরাজিত করতে বা দেশটিকে সংকটে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী নয়। আর এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক বিষয়।’

তবে ওয়াশিংটন ও বেইজিং—দুপক্ষের কেউই মস্কোর ভূরাজনৈতিক ভূমিকাকে তৃতীয় বিশ্বশক্তির সমমর্যাদা দিতে রাজি নয়। তাই হোয়াইট হাউস পুতিনের আকাঙ্ক্ষাকে কেবল ‘আংশিকভাবে বুঝতে’ পেরেছে।

আরও পড়ুন

পরবর্তী ধাপে কী

টাইশকেভিচের আশঙ্কা, ইউক্রেনে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আরও বেড়ে যেতে পারে। যুদ্ধের সক্ষমতা থাকা নাগরিকদের আরও বেশি করে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে পারে রাশিয়া।

ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফলের বিষয়ে ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক ইহর রোমানেনকো হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের সাবেক উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রোমানেনকো আল–জাজিরাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক হওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, পুতিন সেখানে ‘বৈধতা’ পেয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিকভাবে ‘একঘরে’ অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে।

রোমানেনকো মনে করেন, পুতিনকে এমনভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। পুতিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক দুর্জন ব্যক্তি যাঁকে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করা উচিত।

রোমানেনকো আরও বলেন, ট্রাম্প রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করেননি। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো অবস্থানও নেননি। সুতরাং যতক্ষণ না ট্রাম্প নিজের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি দেখাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইউক্রেনকে আরও জটিল লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে হামলা জোরদার করবে এবং ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা আবারও শুরু করবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা। তিনি মনে করেন, এখন ইউক্রেন কর্তৃপক্ষকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেন যুদ্ধে অংশগ্রহণের সক্ষমতা থাকা সব মানুষকে প্রস্তুত করা যায় এবং সামরিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে অর্থনীতিকে পরিচালনা করা যায়।

আরও পড়ুন