সরকারি ভবনগুলোতে কেন ছুটছেন হাইতির রাজধানীর বাসিন্দারা

হাইতির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে সড়কে জ্বলছে আগুনফাইল ছবি: রয়টার্স

হাইতির রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্সের অনেক বাসিন্দা গতকাল শনিবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সেখানকার সরকারি ভবনগুলোতে ঢোকার মরিয়া চেষ্টা চালান। দলবদ্ধ সহিংসতার সাম্প্রতিকতম কিছু ঘটনার পর দেশটির রাজধানীবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও পুলিশ সদর দপ্তরকে নিশানা বানায় সশস্ত্র হামলাকারীরা। এ অবস্থায় ‘অবরুদ্ধ নগরী’ পোর্ট–অ–প্রিন্সের ব্যাপারে জাতিসংঘের একটি সংস্থা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।

হাইতির বিভিন্ন ‘অপরাধী গোষ্ঠী’ এরই মধ্যে অবরুদ্ধ রাজধানীর এক বড় অংশের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চল অভিমুখী সড়কগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল হেনরিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা। এতে সম্প্রতি ব্যাপক সহিংসতা–বিশৃঙ্খলার মুখে পড়েছে দরিদ্র দেশটি।

নিরাপদ আশ্রয়লাভের চেষ্টায় গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ভবনে ঢোকার চেষ্টা চালান বেশ কিছু মানুষ। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ একটি ভবনে ঢুকতে সক্ষমও হন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম গতকাল বলেছে, দেশজুড়ে চলা অস্থিরতা–সহিংসতায় ৩ লাখ ৬২ হাজারের মতো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাঁদের অর্ধেকের বেশিই শিশু। গৃহহীন মানুষের অনেকে একাধিকবার বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছেন।

আইওএমের প্রধান ফিলিপ ব্র্যানচ্যাট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘হাইতিবাসী স্বস্তির জীবনযাপন করতে পারছেন না। তাঁরা ভয়–আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। প্রতিদিন, প্রতিটি ঘণ্টা এ অবস্থায় কাটাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের শারীরিক–মানসিক আঘাত ক্রমেই বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে।’

‘লোকজন রাজধানীতে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাঁদের। শহরটি ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। চারদিকে বিপদ। এটি এক অবরুদ্ধ নগরী’, বলেন ফিলিপ ব্র্যানচ্যাট।

সম্প্রতি ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও পুলিশ সদর দপ্তরকে নিশানা বানায় সশস্ত্র হামলাকারীরা। এ অবস্থায় ‘অবরুদ্ধ নগরী’ পোর্ট-অ-প্রিন্সের ব্যাপারে জাতিসংঘের একটি সংস্থা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে।

হাইতি পুলিশ ইউনিয়নের কর্মকর্তা লিওনেল ল্যাজারে বলেন, গত শুক্রবার রাতে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলা প্রতিহত করেছে পুলিশ। এ সময় কয়েকজন হামলাকারী নিহত হন। তবে কোনো পুলিশ সদস্য হতাহত হননি।

ঘটনাস্থল থেকে এএফপির একজন সংবাদদাতা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে ও এর কাছাকাছি বিভিন্ন সড়কে যানবাহন জ্বলতে দেখেছেন তিনি।

শুক্রবার দিন শেষে পোর্ট–অ–প্রিন্সের বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। দেখা গেছে, পুলিশ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হতে। দৃশ্যত গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা রাজধানীর কেন্দ্রে পুলিশ স্টেশনগুলো দখলের চেষ্টা চালান।

লিওনেল ল্যাজারে পুলিশের কার্যালয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবন রক্ষায় গতকাল কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চান।

জরুরি অবস্থা
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দুটি কারাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। হামলায় কারাগার থেকে ৩ হাজার ৮০০ জনের মতো বন্দী পালিয়ে গেছেন।

কিছু সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হাইতির সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও প্রধানমন্ত্রী হেনরির পদত্যাগ চাইছে। গত মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানোর কথা ছিল। এর পরিবর্তে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিরোধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন তিনি।

আরও সহিংসতা ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী হেনরির প্রতি জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্কারকাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সহিংসতা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন কেনিয়ায় ছিলেন তিনি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের পুয়ের্তো রিকোতে তিনি আটকে পড়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

লোকজন রাজধানীতে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাঁদের। শহরটি ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। চারদিকে বিপদ। এটি এক অবরুদ্ধ নগরী।
ফিলিপ ব্র্যানচ্যাট, আইওএমের প্রধান

কয়েক মাস বিলম্বের পর গত বছরের অক্টোবরে কেনিয়ার নেতৃত্বে হাইতিতে একটি বহুজাতিক পুলিশ মিশন পাঠানোর চূড়ান্ত সবুজ সংকেত দেয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু কেনিয়ার আদালতের হস্তক্ষেপে হাইতিতে এ পর্যন্ত ওই মিশন পাঠানো সম্ভব হয়নি।

রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্স ও হাইতির পশ্চিমাঞ্চলে এক মাস ধরে জরুরি অবস্থা চলছে। গত সোমবার পর্যন্ত কার্যকর ছিল নৈশকালীন কারফিউ।  

আরও পড়ুন

রেহাই পাননি সাধারণ সিগারেট বিক্রেতাও  
ফ্যাবিওলা সানোন পোর্ট–অ–প্রিন্সের বাসিন্দা। বর্তমান সহিংসতা নিয়ে এএফপিকে তিনি বলছিলেন, তাঁর স্বামী জেমস একজন সাধারণ সিগারেট বিক্রেতা ছিলেন। সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি।

ফ্যাবিওলা বলছিলেন, বাচ্চাদের সকালের নাশতার খরচ জোগাতে জেমস খুব ভোরে উঠে সিগারেট বেচতেন। নাশতা খাইয়ে তাদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। জেমসের সঙ্গে কারও কোনো বিবাদ ছিল না।

হাইতিতে খাদ্যপণ্য আমদানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ দেশটির বিমানবন্দর। লুটপাটের পর গত বৃহস্পতিবার থেকে বিমানবন্দরটি বন্ধ রয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) মার্সি কোর এক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছে, বিমানবন্দরে খাদ্যপণ্যবোঝাই কনটেইনারগুলো আমরা বুঝে না পেলে শিগগিরই ক্ষুধার মুখে পড়বেন হাইতিবাসী।

হাইতিতে চলা সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করতে আগামীকাল সোমবার বৈঠকে বসতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জ্যামাইকায় আসার অনুরোধ জানিয়েছে ক্যারিবীয় দেশগুলোর জোট ক্যারিকম।

গায়ানার প্রেসিডেন্ট ইরফান আলী বলেন, হাইতিতে নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও জরুরি মানবিক সহায়তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হবে।

হাইতিতে সহিংসতার কবলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা, যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে বেঁচে যাওয়া নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। সহিংসতার জেরে ইতিমধ্যে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

আইওএমের ফিলিপ ব্র্যানচ্যাট হাসপাতালগুলোতে দুর্বৃত্তদের হানা দেওয়ার ঘটনা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ভীষণ ঘাটতিতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, কিছু হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ এখন দুর্বৃত্তদের হাতে। তারা হাসপাতালের কর্মী ও রোগী, এমনকি নবজাতকদের সেখান থেকে বের করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন