ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী গতকাল বুধবার দেশজুড়ে বহুল আলোচিত লংমার্চ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা বা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করো’ নামে এই পদযাত্রায় রাহুলের সঙ্গী হবেন কংগ্রেসের শতাধিক নেতা। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই লংমার্চ কর্মসূচি দিয়ে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
গতকাল বিকেলে ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন রাহুল গান্ধী। ৫ মাসে দীর্ঘ ৩ হাজার ৫৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ১২টি রাজ্য অতিক্রম করে এই লংমার্চ শেষ হবে সর্বোত্তরের রাজ্য কাশ্মীরের শ্রীনগরে।
দীর্ঘ এই যাত্রাপথে দিনে জনগণের সঙ্গে মিলিত হবেন রাহুল। করবেন অস্থায়ী তাঁবুতে রাতযাপন। দলীয় ওয়েবসাইটে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। জনগণকে দলের বার্তা দিয়ে বাজানো হবে গান। এ রাজনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা শশী থারুর বলেন, ‘ভারতের সংবিধানে ধারণ করা আদর্শ রক্ষায় নানাভাবে আমরা অস্তিত্বের সংগ্রামে রয়েছি। এই লংমার্চের বার্তা হলো আমরা হলাম সেই দলের, যে দলটি ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে এবং ক্ষমতাসীন দলের ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভিত্তিক বিভাজনের প্রক্রিয়া থামাতে পারে।’
কংগ্রেসের আরেক নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, একইভাবে এ পদযাত্রা একটি হতোদ্যম দলের প্রেরণাকে পুনরুজ্জীবিত করার এবং দলের নেতার ক্ষয়ে যাওয়া ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করারও একটি প্রচেষ্টা।
জনগণের কথা শোনা সব সময় একটি ভালো ধারণা। ২০১৪ সালে মোদি ভারতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কংগ্রেসের বিরামহীন পতন চলছে। পরপর দুটি সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির কাছে ধরাশায়ী হয় দলটি। বিধানসভা ভোটে দেশটির ৪৫টি রাজ্যের ৪০টিই হাতছাড়া হয়। বর্তমানে ছোট্ট দুটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা দলটি কোন্দলে জর্জরিত।
এটা স্পষ্ট নয়, কংগ্রেস একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভিশনের বাইরে কী চাইছে। দলটি তার ভোটব্যাংকের বেশির ভাগ বিজেপির কাছে খুইয়েছে। রাহুল নিজেও দলের নেতৃত্ব নিতে অনাগ্রহী বলে মনে হয়েছে।
বিজেপির মতো মরিয়া ও সম্পদসমৃদ্ধ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে না। অনেকেই মনে করছেন, শুধু একজন জনপ্রিয় নেতার নেতৃত্বেই এ ধরনের পদযাত্রা সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
রাহুল যে জনপ্রিয় এখন পর্যন্ত তেমন কোনো নজির মেলেনি। ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের ওপর চালানো নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, তাঁদের মাত্র ৯ শতাংশেরই রাহুলকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ। যেখানে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ অর্ধেকেরও বেশির।
বিজেপির জাতীয় কমিটির সহসভাপতি বৈজয়ন্ত জয় পান্ডে বলেন, ‘নেতার মৌলিক ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে কোনো জনসংযোগ কর্মসূচি সফল হয় না। দুই দশক ধরে রাহুল গান্ধী জনসম্পৃক্ততার সম্পূর্ণ ঘাটতি বারবার দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাসযোগ্যতার সামান্য কিছুও দেখাতে পারেননি।’
কংগ্রেস নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জয়া হাসান। তিনি বলেন, দলটি আশা করছে, এই পদযাত্রা রাহুলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। এই লংমার্চ তাঁকে ফের জাতীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা বলেই মনে হচ্ছে।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, ভারতীয় সমাজে যখন ব্যাপকভাবে মেরুকরণ করা হয়েছে, এমন সময়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকে মনোনিবেশ করা একটি আবশ্যিক বার্তা। সবার উচিত এটাকে স্বাগত জানানো।
তবে ভারতের সাম্প্রতিক লংমার্চগুলোর ফলাফল মিশ্র। ১৯৮৩ সালে বিরোধীদলীয় নেতা চন্দ্র শেখর একই ধরনের লংমার্চ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। নিজেকে তৃণমূল নেতা হিসেবে দেখাতে দীর্ঘ ছয় মাস চার হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করেন তিনি।
৫৬ বছর বয়সী এই নেতাকে ‘ম্যারাথন মানব’ নাম দিয়েছিল মানুষ। তবে এই পদযাত্রা থেকে কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারেননি চন্দ্র শেখর। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার ঘটনায় জনগণে সহানুভূতির জোয়ারে পরবর্তী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল কংগ্রেস।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি লংমার্চ ভারতীয় রাজনীতি পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালে ওই লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা এল কে আদভানি। মিনি ট্রাকে ১০ হাজার কিলোমিটার যাত্রার পরিকল্পনা করেন তিনি, যা দেখতে অনেকটা রথের মতো ছিল।
আদভানি পশ্চিমাঞ্চলীয় মন্দিরের শহর সোমনাথ থেকে উত্তরের অযোধ্যায় এই লংমার্চ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণে সমর্থন জোগাতে এই লংমার্চের আয়োজন করা হয়। (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জেরে ভারতের ইতিহাসে কয়েকটি প্রাণঘাতী ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে)।
লংমার্চ শুরুর মাত্র এক মাস পরই আদভানির এই কর্মসূচি আটকে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রাসাদ যাদব তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। ওই সময় পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্য শাসন করছিলেন লালু প্রাসাদ। তিনি বলেন, ‘মানবতা রক্ষায়’ তিনি এটা করেছিলেন। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে বিজেপির কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় জায়গা করে দিতে আদভানির এই পদযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনকে উপেক্ষা করে ১৯৩০ সালে গুজরাটের পশ্চিম উপকূলে মহাত্মা গান্ধী ৩৮০ কিলোমিটার যাত্রা করেন। তাঁর ওই যাত্রা এখন পর্যন্ত ভারতে সবচেয়ে ঐতিহাসিক লংমার্চ হিসেবে বিবেচিত হয়। ওই পদযাত্রায় ৬১ বছর বয়সী গান্ধীকে আতিথ্য দেওয়া, খাওয়ানো ও থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন গ্রামবাসী। যদি তাঁর শরীর ছেড়ে দেয়, সেজন্য তাঁকে বহন করার জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই যান। গণমাধ্যম এই লংমার্চকে ‘মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক’ বলে অভিহিত করেছিল।
কর্মসূচি হিসেবে লংমার্চের প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। ১৯৩৪ সালে রেড আর্মির ৮৬ হাজার সদস্যকে নিয়ে আট হাজার মাইল দীর্ঘ মার্চ করেন মাও সে-তুং। এই মার্চকে আধুনিক চীনের ভিত্তি হিসেবেই দেখা হয়। মাও এই লংমার্চকে নতুন চীন গড়ার ধৈর্যের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
তবে বিজেপি নেতা বৈজয়ন্ত পান্ডে বলেন, বর্তমানে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য জনসমাবেশের মাধ্যমে নতুন ধরনের বার্তা গ্রহণের প্রবণতা আছে। সে ক্ষেত্রে লংমার্চ শুধু তখনই সফল হবে, যখন নেতার ‘জনসম্পৃক্ততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা’ থাকে।
রাহুল গান্ধীর লংমার্চ কর্মসূচি তাঁর দলকে পুনরুজ্জীবিত কিংবা রাজনৈতিক পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবে কি না, তা অনুমান করা কঠিন। কংগ্রেস নেতা শশী থারুর বলেন, ‘পদযাত্রা শেষ হলেও ভারতের আত্মার জন্য চলমান এই সংগ্রামে ক্ষান্ত দেওয়া হবে না।’
অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মহেশ রঙ্গরাজনের মতো অনেকেই মনে করেন, রাহুল কী বার্তা দিচ্ছেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তাঁর কথায়, ‘কিসের পক্ষে-বিপক্ষে আপনি তাঁদের জড়ো করছেন? কীভাবে এই পদযাত্রা আপনাকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসবে?’
সাম্প্রতিক জনমত জরিপের আরও বিস্ময়কর ফলাফলের মধ্যে একটি হলো জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৫ শতাংশই বলছেন, মোদির শাসনামলে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এরপরও জনপ্রিয়তায় মোদির অবস্থান ওপরেই রয়েছে। জরিপ বিশেষজ্ঞ যশোবন্ত দেশমুখ বলেন, ‘যেকোনো জনমত যাচাইয়ের সূচক দেখুন, মোদির অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা এবং তাঁর প্রতি ভোটারদের আস্থা কিছু সময় যুক্তির মধ্যে পড়ে না।’
অনেকেই মনে করেন, এটাই রাহুলের কাজকে কঠিন করে দিয়েছে। অধ্যাপক রঙ্গরাজন বলেন, ‘মানুষ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁরা কি মনে করেন এ জন্য সরকার দায়ী? অন্য দলকে সুযোগ দিতে তাঁরা কি ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যথেষ্ট অসন্তুষ্ট?’ শুধু সময়ই বলে দেবে রাহুলের এই দীর্ঘ যাত্রা সফল নাকি ব্যর্থ হবে।