পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্র: ভারতে আসছেন এফবিআইয়ের পরিচালক

গুরপতবন্ত সিং পান্নুন
ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যা ষড়যন্ত্রে ভারতের জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ আনার পর দিল্লি আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) পরিচালক ক্রিস্টোফার এ রে ১১ ও ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে থাকবেন।

ভারতের সরকারি সূত্র ও মার্কিন দূতাবাস এ সফর নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ভারতে থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার এ রে দেশটির ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এএনআই) প্রধান দীনকর গুপ্তর সঙ্গে বৈঠক করবেন।

দুই দেশের ওয়াকিবহাল সূত্র অনুযায়ী, পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগই হবে আলোচনার মূল বিষয়। তদন্তের কাজে ভারত কীভাবে কতটা সহায়তা করবে এবং করতে পারে তা জানা ক্রিস্টোফারের মূল আগ্রহ। ভারতের একটি সূত্র মতে, ওই বৈঠকে ‘খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধী চক্রের বিভিন্ন যোগসাজশ ও জম্মু–কাশ্মীরে পাকিস্তান প্ররোচিত সন্ত্রাসবাদ’ প্রধান আলোচ্য বিষয় হতে চলেছে।

ক্রিস্টোফার এ রে ২০১৭ সালে এফবিআইয়ের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সংস্থার প্রধান হিসেবে এটাই হতে চলেছে তাঁর প্রথম ভারত সফর। গত ১২ বছরে এফবিআইয়ের কোনো পরিচালকেরও এটাই প্রথম ভারত সফর।

ভারতের সঙ্গে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে হঠাৎই খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদ বিশেষভাবে ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি সে দেশের শিখ নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতের হাত থাকার সন্দেহের কথা জানান। সে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ওই সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, অভিযোগটি বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট তথ্য তাঁদের হাতে রয়েছে। তাঁর অনুরোধ ছিল, ভারত ওই হত্যা তদন্তে সহযোগিতা করুক।

ওই অভিযোগ ভারত সরাসরি নাকচ করে দেয়। এর পর থেকে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়নি। ভারত দাবি করে, সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণ কানাডা তাদের হাতে তুলে দিক। কানাডা তা এখনো দেয়নি বলে ভারতের দাবি। কিন্তু সম্পর্কের সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, সে দেশের নাগরিক ও শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও ভারত জড়িত। অভিযোগের পক্ষে তারা বেশ কিছু প্রমাণ দাখিল করে। পাশাপাশি, সে দেশের আদালতে এ নিয়ে মামলাও করে। চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে এক ভারতীয় নাগরিককেও, যাঁর নাম সুনীল গুপ্ত, যিনি নাকি এই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মামলায় এক ভারতীয় কূটনীতিককেও জড়ানো হয়েছে; যদিও তাঁর পরিচয় এখনো গোপন রাখা হয়েছে। প্রধানত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই ক্রিস্টোফার দিল্লি আসছেন বলে সূত্রের খবর।

আরও পড়ুন

নিজ্জর ও পান্নুন দুজনই ভারতের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)–এর কর্তা। পান্নুন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। এসএফজে স্বাধীন খালিস্তানি রাজ্য গড়তে চায়।  

কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানের একটা চুক্তি রয়েছে। পাঁচ দেশের ওই জোট ‘ফাইভ আইজ’ বলে পরিচিত। নিজ্জর হত্যা ও পান্নুন হত্যা চক্রান্ত–সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ওই জোটই সদস্যদেশগুলোকে দিয়েছে বলে দাবি। ভারতের অভিযোগ, অনাবাসী শিখ সম্প্রদায়ের একটা অংশ এই দেশগুলোয় ভারতবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে, ভারতীয় দূতাবাসগুলোয় হামলা করছে, বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বারবার বলা সত্ত্বেও কানাডা সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কারণটি রাজনৈতিক। ট্রুডো সরকার সংখ্যালঘু। তারা সরকারে টিকে আছে সে দেশের শিখ সম্প্রদায়ের সমর্থনের ওপর। কাজেই ট্রুডো বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখদের বিরুদ্ধে এমন কিছু করতে চান না, যাতে তাঁর গদি টলমল করে ওঠে।

পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ভারতের জড়িত থাকার খবরটি প্রথম জানাজানি হয় ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের মাধ্যমে। গত নভেম্বরে ওই সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, হত্যা ষড়যন্ত্রে এক ভারতীয় কূটনীতিকের যোগসাজশ, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যাওয়া এবং মামলা করার বিষয়গুলো লেখা হয়।

কানাডার অভিযোগ অস্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ভারত উড়িয়ে দেয়নি; বরং প্রথম থেকেই সহযোগিতার কথা বলে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো দেশে সে দেশের নাগরিককে হত্যা বা হত্যার চক্রান্তের কোনো অভিযোগ কেউ আনেনি। সেদিক থেকে প্রথমে কানাডা এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে বোঝা যাবে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের সরকারি মানসিকতায় বিপুল বদল ঘটেছে।  

সূত্র অনুযায়ী, ক্রিস্টোফার এ দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেমন বৈঠক করবেন, তেমনি আলোচনায় বসবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও। আলোচনায় ভারত জোর দেবে সন্ত্রাসবাদ, আগ্নেয়াস্ত্রের কারবার ও সংঘটিত অপরাধের ওপর।